Logo
Logo
×

বাতায়ন

অবসান ঘটুক উদাসীনতা ও অরাজকতার

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অবসান ঘটুক উদাসীনতা ও অরাজকতার

একই ধরনের একের পর এক দুর্ঘটনা দেশে ঘটছে কেন-এর একটা বড় ব্যাখ্যা হলো, মূল কারণ চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সম্প্রতি একটি বিজনেস গ্রুপের অক্সিজেন প্ল্যান্টে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে, তেমনটি ঘটেছিল বছর দেড়েক আগে একই এলাকার একটি বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে। সেটা ছিল আরও ভয়াবহ। উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে ফায়ার ফাইটারদের ক’জনও তাতে মারা যান। তারা তো জানতেন না আর বুঝতেও পারেননি, ওখানে মারাত্মক দাহ্য বস্তুর কনটেইনারও রয়েছে।

ওই ঘটনায় বিচার শেষ না হতেই আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা ওই এলাকায়। সেখানে এর আগে কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা ছিল, যেগুলো পরে লোকসানি হয়ে বন্ধ হয় এবং বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ায় এর জমিজমা হস্তান্তরিত হয় ব্যক্তি খাতে। আমরা কৃষির পাশাপাশি শিল্পবাণিজ্যেও ব্যক্তি খাতের বিকাশ ঘটিয়ে চলেছি এবং এটা প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ কিছু এলাকায় শিল্পকারখানা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে বিশেষ কারণে। ইপিজেডসহ বিধিবদ্ধ শিল্পাঞ্চলও গড়ে তোলা হচ্ছে পরিকল্পনার আওতায়। ওইসব অঞ্চলে কিন্তু শিল্পকারখানার একটা নিরাপদ বিকাশ ঘটছে।

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এ পরিকল্পিত যাত্রাকে ইতিবাচক উপাদান হিসাবে সামনেও আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে শিল্পকারখানায় সংঘটিত বড় দুর্ঘটনাগুলো সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং দেশের জন্য নেতিবাচক বলেই বর্ণিত হবে। তবে আমরা লক্ষ করব, দেশের প্রধান ম্যানুফ্যাকচারিং খাত গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক ও কারখানা নিরাপত্তায় বড় অগ্রগতি এসেছে। সেখানে অগ্নিসহ সব ধরনের দুর্ঘটনাই অনেক কম এখন। আলোড়ন সৃষ্টিকারী দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে। এটা সম্ভব হয়েছে অবশ্য নিজেদের প্রচেষ্টায় নয়। আমাদের গার্মেন্ট পণ্য আমদানিকারকদের চাপে এবং তাদের উদ্যোগে।

তবে এ প্রক্রিয়ায় যোগদান করে আমরা লাভবান হয়েছি। দেশের অর্থনীতি চাপে থাকাকালে গার্মেন্ট খাত কিন্তু ভালো করছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ যখন কম এবং আরও নেমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, তখন প্রধানত গার্মেন্ট রপ্তানি থেকে আমরা নির্ভরযোগ্যভাবে বিদেশি মুদ্রা পাচ্ছি। প্রবাসীদের আয় তো অনেকাংশে হুণ্ডির মাধ্যমে এসে থাকে বলে তা খাতাপত্রে প্রবেশ করে না।

কথা হচ্ছিল রপ্তানিমুখী খাত গার্মেন্ট শিল্পে নিরাপত্তা শর্ত অর্থাৎ ‘কমপ্লায়েন্স’ নিশ্চিত হওয়া নিয়ে। সীতাকুণ্ডে যে দুটি দুর্ঘটনা কম সময়ের ব্যবধানে ঘটে গেল, তাতে এখন আলাদা করে নজর দিতে হবে অধিক স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পের দিকে। বেশি করে নিরাপত্তা শর্ত পূরণ হওয়ার কথা এগুলোয়। একদম লোকালয়ের মধ্যে অন্যান্য শিল্পকারখানার সঙ্গে অক্সিজেন প্ল্যান্ট কীভাবে গড়ে ওঠে, সেটা তো বোধগম্য নয়। দ্বিতীয়ত, দাহ্য রাসায়নিকের কনটেইনার কোত্থেকে, কীভাবে পরিবহণ এবং কোথায় রপ্তানির জন্য মজুত করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট প্রটোকল থাকার এবং তা শতভাগ মানার কথা। আজকের এ সময়ে এসেও এসব ব্যাপারে আমরা উদাসীনতা প্রদর্শন করছি কেন, সেটা এক বড় প্রশ্ন।

পুরান ঢাকার লোকালয়ে অনেক আগে থেকে না হয় রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম গড়ে উঠেছে এবং এটা বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার অংশও বটে। সেখানে অনেক প্রাচীন ও জরাজীর্ণ ঘরবাড়িও রয়েছে এবং রাস্তাঘাট খুব অপ্রশস্ত। যেনতেনভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির সরবরাহ নেওয়ার ঘটনাও সেখানে বেশি। এর মধ্যে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক মানুষকে বের করে নিয়ে আসা কঠিন সংস্কারের বিষয়। অনেক বছর আগে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে একটি জরাজীর্ণ ভবন ধসে অনেকে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন।

এ ধরনের আরও ভবন কিন্তু ওই এলাকাতেই রয়েছে এবং একশ্রেণির মানুষ সেখানে এখনো বাস করছে কম ভাড়াসহ নানা কারণে। একই স্থানে একসঙ্গে ব্যবসা ও বসবাস পুরান ঢাকার বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনধারার অংশ। তারপর অবশ্য নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদাম থেকে ঘটা বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, রাসায়নিকের ব্যবসা আলাদা কোনো জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। সে প্রক্রিয়া কিন্তু চলমান, যদিও এর মাত্রাতিরিক্ত ধীরগতি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। একের পর এক মন্ত্রী, সচিব মেয়াদ পার করে চলে গেলেও রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।

রাজধানীতে সম্প্রতি দুটি এলাকার দুই ভবনে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জমাট বাঁধা গ্যাস থেকে সৃষ্ট। এগুলো রাসায়নিক থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা বলে কোনো খবর নেই। তা সত্ত্বেও এসব দুর্ঘটনার সূত্রেই আমরা স্মরণ করছি পুরান ঢাকায় রাসায়নিক বিস্ফোরণে মানুষের দুই দফায় হতাহত হওয়ার ঘটনা। স্মরণ করছি, কারণ এমনটি তো আবার ঘটতে পারে, যেহেতু রাসায়নিকের গুদাম অপসারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় কিন্তু একইভাবে চামড়ার কারখানাগুলো গড়ে উঠেছিল। সেখানে আলোচিত ধরনের দুর্ঘটনা তেমন না ঘটলেও প্রধানত নদী, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদে কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সাভারের দিকে। এ নিয়েও অনেক জটিলতা, প্রশাসনিক ঢিলেমি ও কারিগরি সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে হয়েছে।

পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে সেগুলোকে নিরাপদে পরিচালনার সুযোগ করে দেওয়ার কাজটি আরও কঠিন বৈকি। তা সত্ত্বেও আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটার আগেই এ কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। একই সঙ্গে পুরান ঢাকার বাইরে রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকা, যেমন মীরসরাই ও সীতাকুণ্ডে জনপদের মধ্যে যেসব স্পর্শকাতর কারখানা ও গুদাম গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলোতে শতভাগেরও বেশি নিরাপত্তা শর্ত পরিপালনের ব্যবস্থা করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। এটাকে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকারও উপরের দিকে রাখতে হবে।

আমরা অবশ্যই রাসায়নিক আমদানি, উৎপাদন, পরিবহণ ও রপ্তানি করব। অক্সিজেনও উৎপাদন করব নিজেদের ব্যবহার ও বিদেশে বিক্রির জন্য। গার্মেন্টসহ দু-তিনটি পণ্যের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতায় থেকে অর্থনীতি চালিয়ে যাওয়ার যে কাঠামো, সেখান থেকে তো বেরুতে হবে। এর ঝুঁকির দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে তা এড়ানোর বন্দোবস্তও করতে হবে এবং মানদণ্ড বজায় রেখে চলতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর সরকারকে কর-রাজস্ব জোগাচ্ছে বলেই যেকোনো ধরনের উৎপাদন ও ব্যবসা যেনতেনভাবে পরিচালনা করতে দেওয়া যাবে না।

আমরা কিন্তু রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হতে দেখছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা বিদ্যুৎ ভবিষ্যতে ব্যবহার করব এবং সেটা অপেক্ষাকৃত সুলভ হওয়ার কথা। একই সঙ্গে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা অর্থাৎ সেটির নিরাপদ ব্যবহারও নিশ্চিত হতে হবে। এ অবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবসা, অক্সিজেন প্ল্যান্ট পরিচালনা দক্ষতার সঙ্গে করতে কেন পারব না? এজন্য নিজস্ব দক্ষ জনবল গড়ে তোলা এবং তাদের পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোরও বিকল্প নেই। সীতাকুণ্ডে সর্বশেষ যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সে প্ল্যান্টে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর বড় অভাব ছিল। এটা কিভাবে সম্ভব?

নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, যেনতেনভাবে কাজকর্মের সংস্কৃতি সরকারি খাতেও আছে। আছে বলেই যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো কাজ এগিয়ে চলেছে, তাদেরই একটি প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে নিয়মবিধির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের নির্মীয়মাণ ভবনের ছাদ ধসে যারা আহত হয়েছেন, তারা কিন্তু ওই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন। তারা নির্মাণ শ্রমিক।

এও ঠিক, রাজউক কেবল নকশা অনুমোদন করছে। সে অনুযায়ী দালানকোঠা গড়ে উঠছে কিনা এবং নিয়মমাফিক এর ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে এগিয়ে আসছে না। প্লট বানিয়ে বরাদ্দ এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের মতো কাজে না গিয়ে সংস্থাটি যদি তার বিধিবদ্ধ কাজ যথাযথভাবে করত, তাহলে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রাজউক আওতাধীন এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ ও এর ব্যবহারে যে অরাজকতা চলছে, সেটা অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।

রাজধানীর সাম্প্রতিক দুটি দুর্ঘটনায়, এমনকি আশপাশের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সূত্রে এর পুরোনো ও নতুন ভবনগুলোর মান আর নিরাপত্তার দিকগুলো সামনে এসেছে। এটা ইতিবাচক। বনানী ও গুলশানের মতো এলাকার বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড এবং তা থেকে বেরিয়ে যেতে না পেরে করুণভাবে মারা পড়ার ঘটনাও তো রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পকারখানা সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে ও পরিচালনা করতে আমরা যেমন ব্যর্থ হয়েছি, তেমনি ব্যর্থতা রয়েছে নতুন ঢাকাকেও নিরাপত্তা শর্ত পূরণ করে গড়ে তোলার কাজে।

সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে প্রলয় ঘটার পর আমাদের এ অঞ্চলেও ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলাপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবধারিতভাবেই সে আলোচনায় এসেছে ঢাকাসহ বিভিন্ন ‘গ্রোথ সেন্টারে’ যেভাবে দালানকোঠাসহ অবকাঠামো আমরা গড়ে তুলেছি, তার টিকে থাকার সক্ষমতার দিকটি। শহরাঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং তা ব্যবহারের যে অরাজক ব্যবস্থা আমরা অনুসরণ করে আসছি, ভূমিকম্প ঘটলে সেটাও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে শঙ্কা রয়েছে।

বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ অবশ্য বন্ধ হয়েছে। এর বিকল্প হিসাবে রান্নায় এলপি গ্যাসের ব্যবহার সম্প্রসারিত হয়েছে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতোই। একই সঙ্গে এ সম্পর্কিত দুর্ঘটনাও দ্রুত বেড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। সুদূর গ্রাম থেকেও আসছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে লোকজন মারা যাওয়ার খবর। প্রাইভেট কারসহ গণপরিবহণে সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডারের নিরাপদ ব্যবহার কতটা নিশ্চিত করা গেছে, সে প্রশ্নও কম জ্বলন্ত নয়। এসব ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত করতে হবে শতভাগ কিংবা তারও বেশি। প্রযুক্তিকে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে এজন্য যে, এর যথাযথ ব্যবহার জানলে সেটা সুবিধাজনক ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক; কিন্তু না জানলে বিপদ।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম