Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বাধীনতা পুরস্কার অনেক বড় বিষয়

Icon

ড. আফরোজা পারভীন

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতা পুরস্কার অনেক বড় বিষয়

এ বছরের স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। নয়জন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান পুরস্কৃত হয়েছেন। তাদের অভিনন্দন জানাই! স্বাধীনতা পুরস্কার দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। সর্বোচ্চ ত্যাগ-কীর্তি-মহিমা যাদের আছে, তারাই এ পদকে ভূষিত হওয়ার যোগ্য। সে হিসাবে ধরে নিচ্ছি-যে নয়জন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কার পেয়েছেন, তারা সবাই সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন; কীর্তি আর মহিমা আছে তাদের। রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদের চেয়ে বেশি ত্যাগ-কীর্তি-মহিমা আছে; কিন্তু পুরস্কারটি আজ অবধি পাননি-এমন কেউ কী নেই!

একসময় জানতাম, দেশের যোগ্য মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে পুরস্কার দেয় সরকার। আবেদন করার প্রথাটি জানা ছিল না। তাহলে যারা আবেদন করবেন না, তারা কোনো দিনই পুরস্কার পাবেন না! কেউ কেউ তো আবেদন করাকে অসম্মান মনে করেন। তাহলে তাদের জন্য এ পুরস্কার অধরাই থেকে যাবে!

এ দেশে এমন সাহিত্যিক, সংগঠক আছেন, যাদের অর্জন প্রশ্নাতীত; বয়স আশি নব্বই, পুরস্কার পাননি। আজীবন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন, করে চলেছেন। সনজীদা খাতুন তেমনই একজন। এ দেশের সব গণআন্দোলনে, রবীন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে, ছায়ানট প্রতিষ্ঠায়, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তার অবদান অনস্বীকার্য। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তার অবদানের কথা নাইবা বললাম। পাশের দেশ থেকে সম্মানিত হয়েছেন; কিন্তু নিজ দেশে তিনি আজও পুরস্কারটি পাননি। কেন পাননি, এটি একটি বড় প্রশ্ন। তিনি নব্বই ছুঁয়েছেন।

আনোয়ারা সৈয়দ হক আর হাসনাত আব্দুল হাই বয়স-জরা উপেক্ষা করে নিরলসভাবে লিখে চলেছেন। তারাও রয়ে গেলেন হিসাবের বাইরে। কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান এক ‘বং থেকে বাংলা’ বা ‘রক্তের অক্ষরে’র জন্যই স্বাধীনতা পুরস্কার পেতে পারতেন, জীবিত অবস্থায়, বহু আগে। তিনি নিভৃতচারী ছিলেন। নির্ভেজাল লেখক ছিলেন। কারও কাছে যেতেন না, বিশ্বাস করতেন লেখাটাই আসল কাজ। তিনিও পুরস্কারটি পাননি। একুশে পদক পেয়েছেন হুইলচেয়ারে বসে মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে তার অনেক জুনিয়রদের সঙ্গে। ব্যক্তিগতভাবে জানি, তিনি অভিমানে পদকটি নিতে চাননি। পরে বিভিন্ন বিবেচনায় নিয়েছেন। তার ‘ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’ কঠিন গবেষণার ফসল। পড়লেই বোঝা যায় তিনি কত বড় লেখক! এ বছরও মরণোত্তর পুরস্কার পেলেন না। তিনি যেমন নিজে কখনো পুরস্কারের পেছনে দৌড়াননি, তেমনি তার জন্য দৌড়ানোরও কেউ নেই। জানি না পদকটি তিনি আদৌ পাবেন কিনা!

মরণোত্তর পদকের ব্যাপারে অনেকের আপত্তি। আজকাল আপত্তিটা জোরেশোরে উঠছে। এ ব্যাপারে আমার মতামত ভিন্ন। আমি মরণোত্তর পদকের পক্ষে। বিশেষ করে ‘একুশে পদক’ এবং ‘স্বাধীনতা পুরস্কারের’ ক্ষেত্রে। যে পুরস্কারের নাম একুশে ও স্বাধীনতা, সেখানে অন্য ক্যাটাগরি যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন কতটা? একুশে পদক ভাষাশহিদ আর ভাষাসৈনিকদের প্রাপ্য। সেখানে যুক্ত হয়েছে অজস্র ক্যাটাগরি। নির্ধারিত ক্যাটাগরির বাইরে নতুন নতুন ক্যাটাগরি যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমার প্রশ্ন, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলা-নাটক-সিনেমা সব কিছুর জন্য তো আলাদা আলাদা পদক/পুরস্কার আছে। সেসব পদক তারা পাচ্ছেনও। আর যদি একটি/দুটি ক্ষেত্রে পদক/পুরস্কারের ব্যবস্থা না থেকে থাকে, সরকারের কাছে আবেদন করে সে ব্যবস্থা করে নেওয়া কঠিন কিছু নয়; কিন্তু সবাই ভাগ বসাচ্ছেন একুশে আর স্বাধীনতা পুরস্কারে। আবার দাবিও তুলছেন মরণোত্তর পদক তুলে দেওয়ার। ভাষাসৈনিকদের কতজন এখন বেঁচে আছেন? তারা সবাই পদক পেয়েছেন কি? মরণোত্তর তুলে দিলে ভাষাশহিদ আর শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের একজনও তো এ পদক পাবেন না? তাহলে যাদের নামে এ পদক, তারা বঞ্চিত থেকে যাবেন। শুধু নিজের পাতে ঝোল টানলে তো চলবে না। ভাবতে হবে, যিনি আজ বলছেন মরণোত্তর তুলে দাও, তিনি যদি জীবদ্দশায় পুরস্কার না পান, মরে গেলে পাবেন না। জানি, মারা যাওয়ার পর কী পেলাম, কী পেলাম না-তাতে পদকপ্রাপ্তর কিছু যায়-আসে না। কিন্তু পরিবারগুলো তো সম্মানিত হয়, তারা তো গর্ব করতে পারে! যেমন আমি গর্ব করছি আমার স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাই শহিদ বুদ্ধিজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাঈফ মীজানুর রহমানকে নিয়ে, পিতা একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক আফসার উদ্দিন আহমেদ অ্যাডভোকেটকে নিয়ে। ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে তাদের নাম। অনেক মা-বোন-ভাই-স্ত্রী আমারই মতো এ পদক বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এতটুকু প্রাপ্তি থেকে তাদের বঞ্চিত করার এ পাঁয়তারা কেন?

এই যে সেলিম আল দীন স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন মরণোত্তর, না থাকলে তো তিনি পেতেন না! জীবিত অবস্থায় তাকে সম্মানিত করা হয়নি, সে দায় তার নয়। যেসব ভাষাশহিদ, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা মরণোত্তর পুরস্কার পাচ্ছেন, জীবিত অবস্থায় তাদের দেওয়ার সুযোগ ছিল না। মরণোত্তর পেলেন বলে তাদের নাম কেউ না কেউ জানল। নইলে আমরা আর কতটুকু ভাষাশহিদ আর শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করি! নিজেদের নিয়ে আমাদের ব্যস্ততা এত বেশি যে, ভুলে যাই ভাষা আন্দোলন না হলে, গণআন্দোলন না হলে, মুক্তিযুদ্ধ না হলে, আমরা থেকে যেতাম পাকিস্তানিদের গোলাম!

একুশে পদক আর স্বাধীনতা পদকে ভাষাশহিদ, ভাষাসৈনিক, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তাদেরই বেশি বেশি পদক দেওয়া উচিত। সে জীবিত হোক অথবা মরণোত্তর। তারপর বিবেচনায় আনা দরকার সর্বোচ্চ কৃতিত্ব যাদের। এবার ফেরদৌসী কাদরী স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। ম্যাগসেসে পেয়েছেন। যোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়েছে পুরস্কার। তিনি গবেষণায় আমার দেশকে বিশ্ব অঙ্গনে নিয়ে গেছেন। তাকে অভিনন্দন! সরকারকে ধন্যবাদ!

প্রতিষ্ঠান হিসাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে পুরস্কার দেওয়া যথাযথ হয়েছে। স্বল্প যন্ত্রপাতি ও সামর্থ্যে প্রতিষ্ঠানটি অসামান্য অবদান রেখেছে। আমাদের দেশে গরমকালে আগুন লাগা নিত্যদিনের ঘটনা। গত বছর সীতাকুণ্ডে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে আগুন লাগার পর ফায়ার ফাইটাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসামান্য কাজই শুধু করেননি, কয়েকজন জীবনও দিয়েছেন। তাদের স্যালুট জানাই!

পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সমতার বিষয়টিও ভাবা দরকার। এবার একজন নারী লেখককেও বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়নি। পেয়েছেন ১৫ জন। অর্থাৎ নারীর অবস্থান ১৫ জনে একজনও না। বাস্তব অবস্থা কি তাই? একুশে পদক পেয়েছেন একুশ জনে তিনজন, স্বাধীনতা পুরস্কার নয়জনে দুইজন আর একটি প্রতিষ্ঠান। নারী কি কাজে এতটাই পিছিয়ে!

একুশে পদক আর স্বাধীনতা পুরস্কারে সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরস্কার দিন দিন সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এবার সাহিত্যে একুশে পদক পেয়েছেন মাত্র একজন, স্বাধীনতা পুরস্কারও একজন। শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলে একুশে পদক পেয়েছেন আটজন। অথচ যাদের নামে পদক, সেই ভাষাশহিদ-ভাষাসৈনিকরা পেয়েছেন মাত্র তিনজন। আগে কমপক্ষে দুই-তিনজন সাহিত্যে একুশে পদক পেতেন। এ দেশে একবার কোনো নিয়ম চালু হলে সেটাই চলতে থাকে। তাই ভয় পাই, সাহিত্যের জায়গাটা অন্য ক্যাটাগরি যুক্ত হয়ে সাহিত্যে পুরস্কার কেড়ে নিচ্ছে কিনা। একসময় না বাদই পড়ে যায়!

নিকট অতীতে এ দেশে পদক/পুরস্কার নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। পদক বাতিলের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এবার যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে পুরস্কার পেয়েছেন, তারা পরীক্ষিত। তাদের কীর্তি প্রশ্নাতীত। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে! চোখের সামনে সনজীদা খাতুন আছেন। তাকে পুরস্কার না দেওয়া কি আমাদের জন্য লজ্জার নয়! কিছু মানুষের আবেদন লাগে না। চেনা বামুনের পৈতা লাগে না। সনজীদা খাতুন তেমনই একজন। কাকে রেখে কাকে দিচ্ছি, সেটাও তো ভাবনার বিষয়।

স্বাধীনতা পুরস্কার কথার কথা নয়! এটা অনেক বড় বিষয়। তাই পুরস্কার প্রদানের সময় অনেক কিছু বিবেচনায় থাকা দরকার। যাকে পুরস্কার দেবেন, তিনি কতটা কাজ করেছেন, সেটা দেখা দরকার আগে। সে কাজ কি একটা স্বাধীনতা পুরস্কার হাতে এনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট? তারপর দেখতে হবে, তিনি স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ কিনা, তিনি অসাম্প্রদায়িক কিনা, মানবতাবাদী কিনা, মামলা-মোকদ্দমায় জেল খেটেছেন কিনা। নিজের অসামান্য কাজ ছাড়াও এসব বিবেচনায় যারা উতরে যান-এ অমূল্য পদকটি তাদেরই হাতে আসার কথা। অন্য কোনো বিবেচনায় নয়।

ড. আফরোজা পারভীন : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম