Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

অবহেলিত উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাগ্য ফিরবে কি?

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অবহেলিত উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাগ্য ফিরবে কি?

জনাব সাহাবুদ্দিন চুপ্পু দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় উত্তরবঙ্গের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। ইতঃপূর্বে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার এবং শামসুল হক টুকু ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষ যেমন আশায় বুক বেঁধেছিলাম, এবার পাবনার একজন জনদরদি মানুষ দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় আমরা নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।

কারণ, সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে গেলেও আমাদের উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে পাবনা জেলা এ পক্ষত্রে শুভংকরের ফাঁকিতে পড়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলের জেলা শহর এবং পাকিস্তান আমলের ১৭ জেলার একটি জেলা হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ঢাকা-পাবনা-ঢাকা সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু করা হয়নি।

স্বাধীনতার পরপরই হাতে নেওয়া প্রকল্প ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে কাজিরহাট পর্যন্ত রেললাইনটি পাবনার মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে অবশেষে প্রায় ৫০ বছর পর বাস্তবায়িত হলেও পাবনা-ঢাকা ট্রেন সার্ভিস চালু হয়নি। এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বক্তব্য হলো, ‘বগি স্বল্পতার কারণেই পাবনা-ঢাকা রেল সার্ভিস চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।’ আর সে কথাটি রেলমন্ত্রী বলেছেন এক বছর আগে।

তাছাড়া জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে নতুন করে যে কয়টি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে একমাত্র পাবনা মেডিকেল কলেজেই ছাত্র ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরুর পর পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে চালুকৃত মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। অতঃপর সেসব মেডিকেল কলেজ আবার চালু করে তারপর নতুনভাবে আরও অনেক মেডিকেল কলেজ অনুমোদিত হয়ে সেসব মেডিকেল কলেজও চালু করার পর কলেজগুলোতে হাসপাতাল স্থাপিত হলেও এখন পর্যন্ত পাবনা মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল চালু করা হয়নি।

তাই বলছিলাম, সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে গেলেও পাবনার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শুভংকরের ফাঁকি আছে! অবশ্য অনেকেই বলতে পারেন, পাবনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও তো নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি বলতে চাই, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পাবনায় নির্মাণ করার কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রকল্পটি হাতে নিয়ে জমি হুকুম দখলসহ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করে প্রকল্পটির ভালো-মন্দ যাচাই করতে করতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

সে অবস্থায়, এতদিন পর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনুরূপ অন্য কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিক অতটা খুশি নই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অনতিদূরেই আমার পাবনার গ্রামের বাড়ি অবস্থিত এবং বছরের বেশির ভাগ সময়ই আমি সেখানেই অবস্থান করি।

আরও উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন বাধা দেওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকল্পটি ঝুলে ছিল এবং পরবর্তীকালে মানুষজনকে মোটিভেট করে সরকার কর্তৃক এলাকার মানুষের চাকরির সুবিধাসহ বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছিল। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা পাবনার মানুষ সেলফ মোটিভেটেড হওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে চলেছে।

এ অবস্থায় ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে জনাব সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের বিষয় এবং এ বিষয়ে পাবনা এবং উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি একজন মানবদরদি ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত। জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে বিচক্ষণতার পরিচয় প্রদানের পর তিনি সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের পদ-পদবিতেও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছেন। সুতরাং, রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেশ ও জাতি যে একজন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সুযোগ্য ব্যক্তি পেয়েছেন, সে কথাটি বলাই বাহুল্য।

আবার স্পিকার হিসাবে উত্তরবঙ্গের গর্বিত কন্যা ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার পদে পাবনার গণমানুষের সংগ্রামী জননেতা শামসুল হক টুকুকে পেয়েও আমরা যারপরনাই গর্বিত এবং আনন্দিত। পাবনার কৃতী সন্তান শামসুল হক টুকুও একজন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব; তিনিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ রাকসুর জিএস ছিলেন।

আজীবন সংগ্রামী এ জননেতাও আমাদের অঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষের কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন নেতা। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, এতদিনেও আমাদের পাবনা মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়নি, পাবনা-ঢাকা সরাসরি ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়নি। অথচ সারা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এ কাজ দুটি পড়ে থাকার কথা ছিল না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি বা উদ্যোগের অভাবেই এমনটি ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় বগির অভাবে একটি পুরোনো জেলা শহরের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রাখা হতো না এবং পাবনা মেডিকেল কলেজের অনেক পরে যেসব মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে, সেসব কলেজে হাসপাতাল চালু হলেও পাবনার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর পার করে দেওয়া হতো না। যা হোক, এসব নিয়ে পাবনার মানুষ মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন; সুতরাং এসব ঘটনা নবনির্বাচিত মহামান্য রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার মহোদয় সবারই জানা বিধায় অচিরেই বিষয় দুটির সমাধান করা হবে বলেই আমাদের ধারণা।

লেখাটির এ অংশে আমি পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নাটোর জেলাসহ পাবনা জেলার সন্নিহিত এলাকার মানুষের শত বছরের পুরোনো প্রাণের দাবিটির কথা তুলে ধরতে চাই। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভারত এবং তৎপরবর্তী পাকিস্তান আমলের পুরোনো ১৭ জেলার এ বাংলাদেশে ঢাকার আরিচা, পাবনার নগরবাড়ী এবং ফরিদপুরের (রাজবাড়ী) গোয়ালন্দ এ তিনটি নদীবন্দর সারা দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল এবং তেমনটাই আছে। আর সেই ব্রিটিশ আমলে আমার পিতৃপুরুষরা আরিচা-নগরবাড়ি-গোয়ালন্দে একটি সেতু নির্মাণের যে স্বপ্ন দেখতেন, পাকিস্তান আমলে আমরা নিজেরাও সেই একই স্বপ্ন দেখতাম।

কারণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১০-১২ বছর পরও যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধাজনক হওয়ায় আমার পিতা এবং তার সতীর্থদের জরুরি প্রয়োজনে ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় যাতায়াত করতে দেখেছি! আর পাবনা থেকে ঢাকা যাওয়ার রাস্তাঘাটের ঝক্কি-ঝামেলা, অসুবিধা ইত্যাদি এড়াতেই তারা ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনে চেপে বসে একবারে শিয়ালদহ গিয়ে নামতেন। অতঃপর আমরাও পাবনা থেকে ঢাকা যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন যাতনাসহ অকল্পনীয় সময় ব্যয় হতো বলে অচিরেই আরিচা-নগরবাড়িতে একটি সেতু নির্মিত হবে বলে দিনরাত স্বপ্ন দেখতাম।

আর একসময় একটি সেতু নির্মিত হলেও তা ব্যবহার করতে আমাদের গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ঘুরে আসতে হয় বলে ভোগান্তির শেষ থাকে না। আর যমুনা সেতু নামের এ সেতুটির ওপর দিয়ে দেশের ১৯ জেলার মানুষসহ ভারত থেকে আগমন-নির্গমনরত বিশালাকার ট্রাক এবং ঈশ্বরদী ইপিজেডের ওয়াগনবাহী দৈত্যাকার যন্ত্রযান চলাচল করায় যমুনা সেতুসহ গাজীপুর থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। সুতরাং আরিচা-নগরবাড়ী-গোয়ালন্দ আরও একটি ত্রিমুখী সড়ক সারা দেশের জন্যই একটি জরুরি প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। আর এ বিষয়ে আঞ্চলিকতার কোনো সুযোগ আছে বলে হয় না। কথাটি বলার কারণ হলো, আঞ্চলিকতার কারণে আমাদের দেশে অনেক প্রয়োজনীয় প্রকল্প সম্পর্কেও অনেকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও ভুল বুঝিয়ে থাকেন! যাক সে কথা।

আরিচা-নগরবাড়ী-গোয়ালন্দ সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তেমনটি করা বা বলা হবে না বলেই আমাদের প্রত্যাশা। বিশেষ করে আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাগ্যাকাশে যে তিন উজ্জ্বল নক্ষত্রস্বরূপ মানুষ আছেন, সে কারণে বহু বছর আগে গৃহীত আরিচা-নগরবাড়ী-গোয়ালন্দ সেতু প্রকল্পটি এবার বাস্তবায়িত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এবং দেশের আর্থিক পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত, একটি ঘোষণা আমাদের চাই-ই চাই।

কারণ, এ সেতু নির্মিত হলে পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীসহ সন্নিহিত এলাকার মানুষজন কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য দ্রুত সময়ে এবং অল্প খরচে রাজধানীতে বাজারজাত করে দুটি পয়সা রোজগার করতে পারবেন। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো দরিদ্র, এখনো অসহায়। পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পাবনা-কুষ্টিয়াসহ আশপাশের সাধারণ মানুষের অনেকেই যেমন জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে দুঃখ-কষ্টে পড়েছেন, তেমনি একইভাবে তিস্তা-ধরলা পারের মানুষও দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়েছেন। আর এসব মানুষের কথা বলা বা শোনার মতো কেউ আছেন বলেও মনে হয় না।

উত্তরবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজও যে খাদ্যাভাবসহ চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুঃখ-কষ্টে আছেন, তার প্রমাণ হলো, অভাবী মানুষের মধ্যে কোনো কর্তৃপক্ষ পাঁচ-দশ বা বিশ বস্তা চাল বা বস্ত্র বিতরণ করতে গেলে হাজার হাজার দুঃখী মানুষ সেখানে এসে জড়ো হন। আর অনাহারী, অভাবী সেসব মানুষের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, তারা কেমন আছেন। এ বিষয়ে যে বা যিনি যতটাই গলাবাজি করে বলুন না কেন, তাদের কেউ না খেয়ে নেই; কিন্তু আদতে কথাটা সত্যি নয়।

আসল কথা হলো, আজও হাজার হাজার মানুষকে না খেয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। হাজার হাজার মানুষকে অর্ধাহার-অনাহারে থাকতে হয়। এ অবস্থায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ দেশ পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে বলতে চাই, এসব অসহায় দরিদ্র মানুষের অবস্থান উত্তরবঙ্গেই বেশি। বিশেষ করে এতদঞ্চলের চর এলাকার মানুষ ভীষণ দুঃখ-কষ্টে আছেন, তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবেও কিন্তু কুষ্টিয়া-পাবনার মধ্যবর্তী স্থানে আরও একটি সেতু নির্মাণ অপরিহার্য।

পরিশেষে আমাদের ভাগ্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো যাদের অবস্থান, তারা এসব বিষয়ে মনোযোগী হবেন তেমনটি প্রত্যাশা করাসহ তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে এসব বরেণ্যব্যক্তির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম