শিক্ষাঙ্গন স্বাভাবিক রাখতে হবে
মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী এক নবীন ছাত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেছিল, তার নিন্দার ভাষা জানা নেই।
অনেক ঘটনাই ঘটে। সবকটা হয়তো মনে তেমন দাগ কাটে না বা আলোড়ন সৃষ্টি করে না। কিন্তু কোনো কোনো ঘটনায় মনে হয়, লজ্জায় মাথা কাটা গেল। তেমন একটি ঘটনা ঘটানো হয় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাসে।
সেটি এতই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা দ্রুত যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা করেন; কাদের নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করতে হবে, সে নির্দেশনা দেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেন। সে অনুযায়ী তদন্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও হাইকোর্টের উদ্যোগ দেখে নড়েচড়ে বসে। ছাত্রলীগও তাদের কিছু কর্মীর অপরাধমূলক আচরণের বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। যা হোক, নির্দিষ্ট সময়ে রিপোর্ট উপস্থাপন করা হলে তার ভিত্তিতে আদালত অভিযুক্ত সাব্যস্ত পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কারের আদেশ দেন। তারা ওই ছাত্রীনিবাসের প্রভোস্টকেও প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা দ্রুতই কার্যকর করা হয়েছে। হাইকোর্ট বেঞ্চ তার পর্যবেক্ষণে ছাত্ররাজনীতির অবনতিশীল ধারায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন এবং স্মরণ করেছেন অতীতে এর গৌরবময় ভূমিকার কথা।
শুধু ছাত্রসমাজের অধিকার আদায় নয়; ব্যাপক মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনেও এককভাবে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল বিরাট। এটি আমরা বারবারই স্মরণ করি যে, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলোর কত তরুণ দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠারও আগে। এ সংগঠনের মধ্য থেকে কত জাতীয় নেতার জন্ম হয়েছে, যারা এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা গঠনে ও ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় এ সংগঠন স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অবশ্য দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। তাতে আমাদের রাজনৈতিক অগ্রগতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে বিষয়ে আলোচনা অবশ্য এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ব্যথিতচিত্তে এ নিবন্ধ লিখছি এবং স্মরণ করছি এ সংগঠনের গৌরবময় অতীতের কথা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একশ্রেণির ছাত্রলীগ কর্মী যা করছে, তাতে ছাত্রলীগ শুধু নয়-মূল সংগঠনও কি ভাবমূর্তির সংকটে পড়ছে না? উচ্চ আদালতকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছেন বলে। চলমান ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে তারা যে মন্তব্য করেছেন, সেগুলোও প্রণিধানযোগ্য। সমাজের সচেতন অংশ হিসাবে ছাত্রদের রাজনীতির অধিকার অবশ্যই থাকবে। এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকারও বৈকি। কিন্তু সেই অধিকারের নামে যদি একশ্রেণির ছাত্র বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তবে সেটি দুর্ভাগ্যজনক। এজন্য সমাজের ঘৃণা শুধু নয়, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থারও মুখোমুখি হতে হবে।
ভালো হতো, যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও যেসব কলেজে ছাত্ররাজনীতি চলছে, সেসব কর্তৃপক্ষ নিজেরাই শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করতে কিংবা তাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারত। সেটি অনেক ক্ষেত্রেই তারা পারছেন না বলে উচ্চপর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনভিপ্রেত ঘটনায় আমরা উচ্চ আদালতকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। এটি সত্যি বলতে উচ্চ আদালতের নিয়মিত কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব ক্যাম্পাসে ও ছাত্রাবাসে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করা। সেজন্য হাউজ টিউটর ও প্রভোস্ট রয়েছেন এবং সর্বোপরি রয়েছেন প্রক্টর। তারা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে ওইসব ঘটনার নিষ্পত্তি শুরুতেই হতে পারে। কেবল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, অন্য কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যার দ্রুত নিষ্পত্তি হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একশ্রেণির নেতাকর্মীর এত দাপট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, শিক্ষা প্রশাসনও অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে জিম্মি। তারাও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, যদিও আইনগত অধিকার পুরোপুরিই তাদের রয়েছে। শিক্ষকদের মধ্য থেকে যারা প্রশাসনিক দায়িত্ব নেন, তারা কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেন না, তার নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। সেই কারণ অনুসন্ধান করাও প্রয়োজন।
স্বাধীনতা-পূর্বকালেও ছাত্ররাজনীতি ছিল এবং তখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল। কিন্তু এখন যেসব অপঘটনা ঘটছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যেভাবে এতে অসহায় দেখাচ্ছে, তেমনটা কখনো দেখা যায়নি। নিশ্চয়ই এরই মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে, যে কারণে আমাদের দেখতে হচ্ছে ভিন্ন ধরনের ঘটনাবলী। এর ফলে উচ্চশিক্ষার পরিবেশই কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? আমরা কি দেশের তরুণদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারছি? তারা কি ক্যাম্পাসে ও ছাত্রাবাসে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে? এ খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার সদ্ব্যবহারও কি নিশ্চিত করতে হবে না? যে অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ও এ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যয় হচ্ছে, তা কি জনগণের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ নয়? আমরা কি এ আশাও করি না যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শুধু জ্ঞানচর্চা হবে না, সেখানে উচ্চতর গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে? অথচ সত্য হলো, দুনিয়ার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে এমনকি এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান করে নিতে পারছে না। এজন্য নিশ্চয়ই ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরাই এককভাবে দায়ী নয়। তবে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্য তাদের নিশ্চয়ই অভিযুক্ত করা যাবে।
সম্প্রতি বিদায়ি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তৃতা করতে গিয়ে শিক্ষাঙ্গনে একশ্রেণির ছাত্র নামধারীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের কর্মকাণ্ডে ছাত্ররাজনীতির প্রতিই যে মানুষ শ্রদ্ধা বজায় রাখতে পারছে না, সেটি উল্লেখ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে আমার শ্রদ্ধাভাজন রাজনৈতিক সহকর্মী রাষ্ট্রপতি হামিদকে কখনো এতটা উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তিনি এখন বিদায়ি রাষ্ট্রপতি এবং বিদায়কালে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মীর আচরণে হামিদ ভাই নিশ্চয়ই ব্যথিত। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মীর এসব কর্মকাণ্ড দেখতে তিনি ও আমরা নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি।
এটা নির্বাচনের বছর এবং নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর একশ্রেণির নেতাকর্মীর আচরণ ততই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মনে হয়। প্রথমত, ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বকেই অনুসন্ধান করে দেখতে হবে কেন এসব ঘটছে। তাদের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, ঘটনা ঘটামাত্র খোঁজ নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাইলে তাতেও সহযোগিতা জোগানো হচ্ছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রীদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এটিও সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে কি অনভিপ্রেত ঘটনার সংখ্যা কমছে? সংবাদপত্র অনুসন্ধান করে জানাচ্ছে, এসব ঘটনা বরং বাড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য আরও বেশি বিব্রতকর ঘটনা ঘটাচ্ছে ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী। তারা যেন মূল দল ও সরকারের জন্য দায় হয়ে উঠেছে। সবারই মনে থাকার কথা, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারের ওপর চাঁদাবাজির ঘটনায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একযোগে প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল। একটি ছাত্রসংগঠনের জন্য এর চেয়ে বিব্রতকর ঘটনা আর কী হতে পারে? প্রত্যাশা ছিল, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সেটা ইতোমধ্যে হয়েছে বলে কি দাবি করা যাবে?
আমরাও ছাত্ররাজনীতি করে জাতীয় রাজনীতিতে এসে যার যার মতো ভূমিকা রেখেছি। কিন্তু এখন যেসব ঘটনা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নামে ঘটছে, তা আমরা কখনো চিন্তাও করতে পারতাম না। ছাত্ররাজনীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে হবে-এ ভাবনার ধারেকাছেও আমরা ছিলাম না। তাই আজ যখন তাদের এসব ‘উচ্চাভিলাষ’র কথা শুনি, তখন অবাক হই। ছাত্ররাজনীতি যারা করে, তাদের প্রথম পরিচয় তারা ছাত্র। পড়াশোনা করে নিজেকে গড়ে তোলাই তাদের প্রথম কাজ। তারপর যার যা রাজনৈতিক বিশ্বাস, সে অনুযায়ী কাজ করবে। এক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেও আমাদের ফিরে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি নিজেও শিক্ষাঙ্গনে দখলদারির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তার সমাবর্তন বক্তৃতায়। সত্যি বলতে, ছাত্রাবাসের সিট দখল ঘিরেই অনেক সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠনও যথাযথ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে না। অর্থের বিনিময়ে পদ ক্রয় করতে হলে তো সেটা হয়ে যায় বিনিয়োগ এবং তাকে এর কয়েকগুণ অর্থ তুলে নিতে তৎপর হতে হয়। এমন কিছু গোড়ার সমস্যায় হাত দিতে হবে বলেই মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের প্রভাবমুক্ত হতে হবে।
আগামী নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা যাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে সেটা ক্ষমতাসীন দলের জন্য আরও বড় দায় হয়ে উঠবে। সামনেই নির্বাচন বলে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, এ মনোভাবও পরিহার করে চলতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী কাজেও একশ্রেণির ছাত্র নামধারী উঠেপড়ে লেগেছে। তারা যেন কোনোভাবে মূল দল বা প্রশাসনের প্রশ্রয় না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর