আশেপাশে চারপাশে
বইমেলা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে
চপল বাশার
প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ শেষ হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। মাসজুড়ে চলা এ মেলা শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে। চার সপ্তাহের মেলায় নতুন বই এসেছে গত বছরের মেলার চেয়ে কিছু বেশি। গতবারের মেলায় নতুন বই ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এবার নতুন বই এসেছে তিন হাজার ৭৩০টি।
কাগজের মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হয়েছিল, এবার নতুন বই কম আসবে। কিন্তু তা হয়নি, প্রকাশকরা বেশি খরচ করে বই ছেপেছেন। ক্রেতাদের কাছ থেকে দামও নিয়েছেন আগের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের বিক্রি কমেছে। ২০২২ সালের বইমেলায় বিক্রির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৫২ কোটি টাকা, এবার বিক্রি হয়েছে ৪৭ কোটি টাকার বই।
করোনা মহামারি এবং এ কারণে আরোপিত বিধিনিষেধের ফলে গত দুই বছর বইমেলা বিঘ্নিত হয়েছে। ২০২১ সালের বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে না হয়ে শুরু হয় মার্চে, এবং ২০২২ সালের মেলা শুরু হয় নির্ধারিত তারিখের দুই সপ্তাহ পরে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে। ২০২১ সালের মেলায় মাত্র তিন কোটি ১১ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। পরের বছর ২০২২ সালে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকায়। বিক্রির এই পরিমাণ অবশ্য ২০২০ সালের তুলনায় অনেক কম। সে বছর বিক্রি হয়েছিল ৮২ কোটি টাকার বই। সেই বইমেলা হয়েছিল করোনা মহামারি শুরু হওয়ার এক মাস আগে।
গতবারের তুলনায় এবারের মেলায় প্রায় আড়াইশ নতুন বই বেশি এসেছে। নতুন বইয়ের সংখ্যা তিন হাজার ৭৩০। সংখ্যাটি বেশ বড়। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক বইয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা কত, সে হিসাব কেউ করেছে কি? বাংলা একাডেমি করেনি, অফিসিয়ালি অন্য কোনো সংস্থাও করেনি। তবে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞজনদের অভিমত-মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা অনেক কম। বিজ্ঞজনদের অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তাদের প্রতিক্রিয়ায়, যা লিখিতভাবে এসেছে পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
বইয়ের বিষয়বস্তু ছাড়াও অধিকাংশ প্রকাশিত পুস্তকের মুদ্রণ-বাঁধাই নিম্নমানের। ফেব্রুয়ারিতে বইটি প্রকাশ করতেই হবে, মেলায় বইটি আনতেই হবে-এই মানসিকতায় তাড়াহুড়ো করে বই ছাপানো হয়। এ কারণে ছাপার ভুল বা মুদ্রণত্রুটি থেকে যায়, বাঁধাই সঠিকভাবে হয় না। ভুলভ্রান্তিতে ভরা বই পাঠক কিনবেন কেন? কিনলেও তারা ঠকে যান।
ফেব্রুয়ারি মাসে বই বাজারে আনার জন্য প্রকাশকরা তাড়াহুড়ো করেন, কারণ তাদের লক্ষ্য বইমেলা। মেলায় বেশি মানুষের সমাগম হবে, বই বেশি বিক্রি হবে-এটাই প্রকাশকদের প্রত্যাশা। তাদের আশা কি পূরণ হয়? হয় না। অধিকাংশ প্রকাশক বইমেলায় স্টল দিয়ে লোকসান দেন, স্টল দেওয়ার খরচও উঠে আসে না। যেসব প্রকাশক ছোট আকারের স্টল দেন, তাদের বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমনকি অনেক খরচ করে বড় প্যাভিলিয়ন যারা দিয়েছিলেন, তাদেরও অনেকে এবার লোকসান দিয়েছেন বলে জানা যায়।
লোকসান হতে পারে জেনেও প্রকাশকরা ছোট বা বড় স্টল দেন, টাকা বিনিয়োগ করেন। কেন করেন? কারণ তারা পুস্তক ব্যবসায় টিকে থাকতে চান, অস্তিত্ব বজায় রাখতে চান; এজন্য মূলত প্রচারের লক্ষ্যেই বইমেলায় অংশ নেন। লেখকরাও চান বইমেলায় তাদের রচিত গ্রন্থ স্থান পাক, স্টলের তাকে বই সাজানো থাকুক, পাঠকরা দেখুক। নতুন লেখকরা মেলার মাধ্যমে পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হতে চান। বই পড়ায় আগ্রহী পাঠকরাও মেলায় এসে তাদের পছন্দের গ্রন্থ খোঁজেন। প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের আগ্রহ ও উৎসাহের কারণেই একুশের বইমেলা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
এবারের বইমেলা আগের মতোই দুটি প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয়েছিল-বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৮৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছোট-বড় স্টল স্থাপন করেছিল। এছাড়াও ছিল ৩৮টি প্যাভিলিয়ন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল ১১২টি প্রতিষ্ঠানের স্টল। এগুলোর প্রায় সবই সরকারি/বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের স্টল, যার সঙ্গে পুস্তক প্রকাশনার সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের নামেও স্টল দেখা গেছে সেখানে। পুস্তক প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন সব প্রতিষ্ঠানকে বইমেলায় স্টল করতে দেওয়ার কী প্রয়োজন, তা বোঝা গেল না। বইমেলা শুধু পুস্তক বা গ্রন্থের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবে, অন্য কিছুর সঙ্গে নয়। এটাই সবার কাম্য।
সদ্যসমাপ্ত বইমেলায় লোকসমাগম কেমন হয়েছিল, তার একটি চিত্র পাওয়া গেছে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত তথ্যে। একাডেমি বলেছে, এবারের মেলার ২৮ দিনে মোট ৬৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬৩ জন এসেছিলেন। এ সংখ্যাটি নিশ্চয়ই মেলার প্রবেশপথে স্থাপিত গণনাযন্ত্রের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক মানুষ একাধিকবার মেলায় প্রবেশ করেছেন, সে কারণে মেলায় উপস্থিতির সংখ্যা বেশি রেকর্ড হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যদি ধরে নেওয়া হয় ৫০ লাখ মানুষ মেলায় এসেছিলেন, সেটাও কম নয়।
মেলায় আগত নারী-পুরুষরা সবাই কি বই কিনেছেন? এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেকে যদি একটি করেও বই কিনতেন, তাহলে মেলার সব বই বিক্রি হয়ে যেত। বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশক-বিক্রেতারা মনে করেন, মেলায় আগত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচ শতাংশও বই কেনেননি। অনেকেই স্টলে এসেছেন, বই দেখেছেন, নাড়াচাড়া করেছেন, তারপর চলে গেছেন বই না কিনেই। পুকুরের পাড়ে এবং খাবার আউটলেটগুলোতে এবার আড্ডা ভালোই জমেছিল। আড্ডা এবং মেলা চত্বরে ঘোরাঘুরিতেই ব্যস্ত ছিলেন বেশির ভাগ ভিজিটর, বিশেষ করে অল্পবয়সি বা নতুন প্রজন্মের মানুষেরা। বইয়ের ধারেকাছেও তারা যাননি।
একজন প্রকাশককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নতুন প্রজন্মের তরুণ-যুবকরা কী ধরনের বই খোঁজেন বা কী বই কিনতে চান? জবাবে প্রকাশক হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, ‘ওরা তো বই পড়ে না, দিনরাত ইন্টারনেট-ফেসবুক-মোবাইল নিয়ে থাকে। বই পড়বে কখন? পড়াশোনার প্রয়োজন হলে ইন্টারনেটে পড়ে। বই স্পর্শ করে না। মুদ্রিত বইয়ের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার।’ প্রকাশক মহোদয় অসত্য কিছু বলেননি। নতুন প্রজন্ম পড়াশোনার নামে ইন্টারনেটের খপ্পরে পড়ছে, যার মাশুল দিতে হচ্ছে সমাজ ও জনগণকে। বিষয়টি নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। সমাজ ও জাতির মহাসর্বনাশ হওয়ার আগেই ইন্টারনেট ও মোবাইলের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেবে সরকার, এটা আশা করা অন্যায় হবে কি?
মুদ্রিত বইয়ের ভবিষ্যৎ কি আসলেই অন্ধকার? আমি তা মনে করি না। ইন্টারনেট প্রযুক্তি মুদ্রিত গ্রন্থশিল্পকে একটু ধাক্কা দিয়েছে বটে; কিন্তু মুদ্রিত গ্রন্থশিল্প তথা প্রিন্ট পাবলিকেশন বন্ধ হয়ে যায়নি। পিছিয়েও পড়েনি। শিক্ষিত সুধীসমাজ মুদ্রিত গ্রন্থকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের বাড়িতে-বসার ঘরে বা পাঠকক্ষে-যথেষ্টসংখ্যক মানসম্পন্ন বই সাজানো আছে দেখা যায়। তারাই প্রতি বছর বইমেলায় যান, নতুন বই কেনেন, নিজস্ব পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করেন। না হলে বইমেলায় এত বই বিক্রি হয় কেন? বই পড়ায় তরুণ সমাজের একাংশের অনাগ্রহ শেষ কথা নয়। প্রাচীনকালেও বই ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ বই সভ্যতার রক্ষাকবচ, বই সভ্যতার প্রসার ঘটায়।
এবারের বইমেলায় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও সামগ্রিকভাবে মেলাটি সফল হয়েছে বলতে হবে। মেলা নির্বিঘ্নে চলেছে পুরো মাস। ঝড়-বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা রাজনৈতিক গোলযোগ মেলাকে বিঘ্নিত করেনি। অব্যবস্থাপনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ধুলার উপদ্রবের কথা। ধুলার কারণে সব মানুষই বিরক্ত হয়েছেন, অস্বস্তিবোধ করেছেন। প্রতিদিন সকালে এবং মেলা চলাকালেও মাঠে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছিটালে ধুলা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত।
মেলার উভয় প্রাঙ্গণেই কাঙ্ক্ষিত স্টল খুঁজে পেতে মানুষের কষ্ট হয়েছে, অনেক হাঁটতে হয়েছে। স্টল নম্বর দিয়ে দিকনির্দেশনা মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্থাপন করা হয়নি। মেলার স্টল নম্বরও সুশৃঙ্খলভাবে দেওয়া হয়নি। সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে স্টল নম্বর দেওয়া হলে মেলায় আগতদের সুবিধা হতো। দুই প্রাঙ্গণে দুটি তথ্যকেন্দ্র ছিল, কিন্তু তা প্রয়োজন মেটাতে পারেনি।
মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকদের সবাই অভিযোগ করেছেন, স্টলের ভাড়া অনেক বেশি হারে আদায় করেছে বাংলা একাডেমি, যে কারণে ছোট প্রকাশকদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কথা উঠেছে, বইমেলার আয়োজন বাংলা একাডেমির হাতে থাকা উচিত কিনা। বাংলা একাডেমির কাজ বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও উন্নত মানের প্রকাশনা নিশ্চিত করা। বইমেলার মতো বাণিজ্যিক কাজ নিয়ে বাংলা একাডেমিকে ব্যস্ত থাকতে হবে কেন? সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার। এ ব্যাপারে বাস্তব, গঠনমূলক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
একুশের বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। এই মেলা বাঙালির সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে যথাযথ অবদান রাখুক, এটাই সবার কামনা।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com