Logo
Logo
×

বাতায়ন

লোকজশিল্প: শিকড়ের সন্ধানে

Icon

ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লোকজশিল্প: শিকড়ের সন্ধানে

অতীতে শিল্প শৌকর্যে সমৃদ্ধ ছিল এ জনপদ। কালের প্রয়োজন ও সামাজিক প্রক্রিয়ায় প্রাচীন লোকশিল্পের অনেক কিছুই আজ বিবর্তিত, বিলুপ্ত ও পরিমার্জিত হয়েছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে আমাদের লোকশিল্প। এক সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য কুটির শিল্প গড়ে উঠে যা আমাদের প্রাচীন লোকশিল্পেরই ধারাবাহিকতা। আমাদের বাঙালি লোকশিল্পের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। ঢাকাই-মসলিন শিল্প এ উপমহাদেশের লোকশিল্পের গর্ব ছিল। এখনো নানা শিল্পসামগ্রী পৃথিবীর নানা স্থানে পৌঁছে গিয়ে সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে। বিজ্ঞান আমাদের নিত্যনতুনের সন্ধান দেয় ঠিকই, কিন্তু একসময় যখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবিষ্কার বা গবেষণা ছিল না, ঠিক সে সময়েও আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাচীন মানবরা আবিষ্কার করে গেছেন নানা জিনিসপত্র। বর্তমান সময়ে সেসব উপকরণ ও জিনিসপত্র লোকশিল্প হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

আমাদের দাদি-নানিরা সংসারের কাজ সেরে অলসদুপুরে বসতেন কাঁথা সেলাই করতে। বর্ষাকালে যখন চারদিকে পানি থৈ থৈ করত অথবা সন্ধ্যার পর সাংসারিক কাজ সেরে হারিকেনের আলোয় বসতেন নানা শিল্প নৈপুণ্যের কাজ নিয়ে। সে সময়ের কাঁথা সেলাই আজ নকশিকাঁথা শিল্পে পরিণত হয়েছে। কাঁথা সেলাইয়ের আধুনিক রূপ যশোর স্টিচ। কালো পাথরের বুকে বাটালির টুক টুক শব্দে পাথর খোদাই হয়ে তৈরি হতো রকমারি নকশা, যা ছাঁচ নামে পরিচিত। এসব ছাঁচে তৈরি হতো নানা ডিজাইনের নকশাখচিত পিঠা ও আমসত্ত্ব। অসহনীয় গরমে ব্যবহার করা হতো হাতপাখার। তালপাতা শুকিয়ে বা বাঁশের চাটাই দিয়ে অথবা কাপড় দিয়ে ডিজাইন করে নানা বৈচিত্র্যের নকশায় তৈরি হতো পাখা। হাতের নিপুণতায় বা সুতার কাজে ফুটে উঠত শিল্প নৈপুণ্য। পাট থেকে তৈরি হতো শিকা, বেণি, বসার আসন, ঝুলন্ত খাট, খেলনা প্রভৃতি। শোলা দিয়ে তৈরি হতো টোপর ফুল ও খেলনা। শোলা গাছ শুকিয়ে কাণ্ড থেকে সাদা অংশ বের করে তৈরি করা হয় নানা শৌখিন সামগ্রী। বর্তমানে এসবে জরি ও চুমকির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বিয়ের টোপর তৈরিতে শোলা শিল্পের ব্যবহার আমাদের মানবীয় অনুভূতিতে স্পর্শ করে। আমাদের সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে মৃৎসামগ্রীর অঞ্চলভিত্তিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। হাঁড়ি, পাতিল, ফুলের টব, প্রভৃতির ব্যবহার হতো প্রতিটি গ্রামে। মৃৎশিল্পকে ঘিরে বিকশিত হয়েছিল কুমার সম্প্রদায়। কুমার চাকার মাধ্যমে মাটি ঘুরিয়ে শৈল্পিক হাতে তৈরি করেন নানা শিল্পসামগ্রী। কুমারদের তৈরি পটচিত্র, কার্টুন ও ভাস্কর্য শিল্প বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছে। আমাদের দেশের প্রত্নস্থলসমূহ থেকে প্রাপ্ত নকশাখচিত ইট ও মাটির তৈরি নানা শিল্পসামগ্রী থেকে প্রমাণিত এ শিল্প ও পেশা প্রাচীন ও পুরোনো।

কাঠ শিল্পের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে ছুতার সম্প্রদায়। খাট-পালঙ্ক, খুঁটি-দরজা-জানালা-বেড়াসহ কাঠের তৈরি প্রায় প্রতিটি উপকরণে একসময় নকশা খচিত থাকত। এ ছাড়া দেখা যায়, কাঠের ফুল-ফলসহ নানা উপকরণ। কাঠের ঢেঁকি আমাদের গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরের প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল। বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হতো চালনি, কুলা, ঢালা, ঢুলি, ঝাঁটা, চাটাইসহ নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। উপকূলীয় অঞ্চলে নারিকেল গাছের প্রাধান্য থাকায় সেখানকার নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি হতো এক ধরনের বিশেষ রশি। নারিকেলের খোল দিয়ে বানানো হতো হুঁকা। এভাবে যুগে যুগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের তৈরি জিনিসপত্র লোকশিল্প হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। যা আমাদের গৌরব ও অহংকার।

আমাদের গ্রাম-বাংলার ও লোকায়ত শিল্পধারা সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতে বিলুপ্ত হতে চলেছে। সাম্প্রতিক ও আধুনিক শিল্পধারার কাছে যুগে যুগে প্রবহমান সাধারণ মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, জীবন সংগ্রাম ও নানা সামাজিক রীতিনীতি, যা আমাদের সন্ধান দেয় শিকড়ের, সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় নাড়ির সম্পর্কের।

বর্তমান সময়ের শিল্পধারায় লক্ষ করা যায় প্রাচ্যের আদল; যা হতে পারে মননশীল চিন্তার উৎস। তবে আধুনিক শিল্পধারা যতই উন্নত হোক না কেন, সেটি প্রাচীন লোকায়ত শিল্পধারার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সংগীত, নাচ-গান, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, লোক ও কারুশিল্প নিজ ভৌগোলিক সীমারেখায় একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের শিল্প; যা আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও ইঙ্গিতবহ।

আমাদের লোক ঐতিহ্যময় কারুকাজ সাধারণ মানুষের জীবনের আবেগ, নান্দনিকতা নিয়ে আজও চলমান। লোকজ শিল্প সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের লোকশিল্প শক্তিশালী হলেও বহু উপকরণ নীরবে-নিভৃতে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভূখণ্ডে সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা হারানোর সূত্রপাত ইংরেজ উপনিবেশ আমলে। কালে কালে নানা গোষ্ঠী আমাদের বহমান ঐতিহ্যময় শিল্পধারাকে থামিয়ে নিজেদের মতবাদ চাপিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনোটিই স্থায়ী রূপ পায়নি। অনেকে দখলিকৃত দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে নিজেদের দেশের উন্নতি করেছে। কালচক্রে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ক্ষমতাভোগকারী দেশগুলো থেকে জন্মলাভ করেছে ইউরোপীয় বা পশ্চিমা সভ্যতা। দুঃখজনক যে, যেসব দেশ কখনো উল্লেখযোগ্য সভ্যতার ধারকবাহক ছিল না তাদের সম্মিলিত সভ্যতা এখন প্রভাবশালী। তবে আমাদের জাতিসত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিকড়ের স্বরূপকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে আমাদের মনে রাখা উচিত বাংলার লোকজশিল্প যুগে যুগে সব সময়ে শিল্পের অফুরন্ত উৎস হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে; যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে টিকিয়ে রাখতে হবে।

আমাদের লোকশিল্প নিজ ভুবনে চিরভাস্বর, যার নিজস্ব প্রাণবন্ত ঐতিহ্য রয়েছে। এটি সাধারণ লোকের জন্য সাধারণ মানুষের সাধারণ উপকরণে তৈরি। ফলে লোকজ শিল্পসামগ্রী সবস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমাদের লোকজশিল্প কোনো একক শিল্পীর শিল্পকর্ম নয়; প্রাচীনকাল থেকে এটি একটি সুসংহত সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেও সৃষ্ট হয়নি। প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনেই পূর্বপুরুষদের লোকবিশ্বাস সম্পৃক্ত হয়ে নানা প্রতীকী অলংকরণের মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে; যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লোকশিল্প নিজ অবয়বে বিকশিত হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক পণ্ডিত ইতিহাস শাস্ত্রের জনক হোরোডোটেস এ শিল্পের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে চিন্তা করলেও তেমন বিস্তার লাভ করেনি। ১৮৪৬ সালে ডব্লিউ জেটমাস ফোকলোর শব্দ ব্যবহার করে সঠিক নামকরণ করেন (আহমদ তোফায়েল, ১৯৮৫)। পরবর্তী সময়ে দেশকাল ছাড়িয়ে নিজ অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মৌলিক ও উন্নততর কিছু সৃষ্টির বাসনায় শিল্পী ও তার সময়কারদের আবেগ জড়িয়ে যায় শিল্পকর্মের সঙ্গে। লোকশিল্পীরা সৃজনশীল আবেগের অভিব্যক্তি ঘটান তাদের শিল্পকর্মে। সৃষ্টির আনন্দে মটিফগুলোকে আঁকড়ে ধরে নতুন অবয়বের সূচনাও করেন তারা। সৃজন প্রক্রিয়া, রুচি ও চাহিদার কথা ভেবে শিল্পী তার শিল্পকর্ম তৈরি করেন কখনো খালি হাতে আবার কখনো সাধারণ উপকরণ সুচ, কাঁচি, তুলি, দাও-হাতুড়ি, বাটালি, কুঠার প্রভৃতি ব্যবহার করে। অতি সাধারণ উপকরণ মাটি, কাপড়, কাঠ, বাঁশ, বেত, শোলা, গমের নাড়া, ডাল, খেজুর পাতা প্রভৃতি ব্যবহার করেই কুশলী হাতের স্পর্শে তৈরি হয় নানা অবয়ব আকৃতির জিনিস।

আমাদের লোকশিল্প অনেক পুরোনো ও বিস্তৃত। নকশিকাঁথা, লোকচিত্র, পাখা, পাটি, শিকা, খেলনা পুতুল, মাটির ফলক, দারুশিল্প, বাঁশ ও বেতের বেড়া, কলকি, হুঁকা, লোক অলঙ্কার, লোক বাদ্যযন্ত্র, নকশিপিঠা, নকশিসাঁচ, মাছ ধরার উপকরণ, দেওয়ালচিত্র, ঘুড়ি, মুখোশ, পিঁড়িসহ নানা কিছু নিয়ে লোকশিল্পের বিস্তৃত জগৎ। অপূর্ব এসব রচনাশৈলী যুগযুগান্তরের উদ্ভাবনী শক্তি ও অভিজ্ঞতার ফসল। একসময় এ শিল্প নিজস্ব চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হলেও কালক্রমে বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। এভাবেই শিল্পের নিজস্ব ধারার পরিবর্তন ও বিলুপ্তি ঘটে।

অন্যদের অভিরুচির কারণে নিজস্ব বৈশিষ্ট ও অবয়বের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুণগত মানের পরিবর্তন হয়। শৌখিন মানুষের চাহিদা মেটাতে গিয়ে লোকশিল্প স্বকীয়তা হারায়। কারুবিপণির দৌরাত্ম্যের ফলে এ শিল্পে নাভিশ্বাস নেমে আসে, শিল্পের ঐতিহ্য নষ্ট হওয়ায় শিল্পীরাও হারিয়ে ফেলে দরদ ও অনুভূতি। যন্ত্রচালিত শিল্পের প্রসার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্পকে চড়াদামে কিনে পাশ্চাত্যে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে আমাদের অতীত। লোকশিল্পের লালন ক্ষেত্র আমাদের গ্রাম-বাংলা, কিন্তু এ গ্রামীণসমাজ কাঠামোতে ফাটল ধরানো হয়েছে। একশ্রেণির লোভী মানুষের কারণে লোকশিল্পের স্বতন্ত্র্যধারা ব্যাহত হচ্ছে। এসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের এ ঐতিহ্যে আর কত দিন স্বমহিমায় টিকে থাকবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন : গবেষক; পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), তথ্য ও গণসংযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম