Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা ও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে তাবলিগ জামাত

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা ও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে তাবলিগ জামাত

কদিন আগে তাবলিগ (প্রচার, ধর্মপ্রচার) জামাতের দুই পর্বের বার্ষিক ইজতেমা শেষ হয়ে গেল। হাজার হাজার খোদাভীরু মুসল্লি এতে প্রতি বছর অংশ নেন। অনেক বছর আগে থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটা অংশের বৃহৎ সমাবেশ এভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দলমত নির্বিশেষে অনেক কষ্ট করে আল্লাহর উদ্দেশে ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য মুসলমানরা এখানে সমবেত হন। বিভিন্ন দেশ থেকেও মুসল্লিরা তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে ইজতেমার মাঠে আসেন। ইজতেমা অর্থ সম্মেলন বা বহুলোকের সমাবেশ। আমাদের দেশের অনেকেই ইজতেমা শব্দের সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু ইজতেমা শব্দের প্রকৃত অর্থের সঙ্গে পরিচিত নন। আমরা জানি, ইজতেমার মাঠে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বয়ান (বক্তব্য বা ধর্মীয় আলোচনা) হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। সে বয়ান কতটা দুনিয়ার কর্মজীবন, কর্মাচার ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে, তা আমার জানা নেই। শেষের দিনে যে মোনাজাত হয় তাকে আমরা আখেরি (শেষ বা অন্তিম) মোনাজাত বলে বুঝি। আমাদের দেশের, বিশেষ করে ঢাকা শহরের বহু মানুষ আখেরি মোনাজাতে শামিল হন। ইহকালের সব কাজ ফেলে রেখে আমরা খোদার রাস্তায় মনোনিবেশ করি। মোনাজাতকে ঘিরে অনেক কল্যাণপ্রাপ্তির সুবিধা খুঁজি। দুনিয়ার গোমরাহির পথকে পিছে ফেলে অন্তত একদিনে পরকালের নাজাত (মুক্তি, নিষ্কৃতি) পাওয়ার চেষ্টা করি। ইসলামের দৃষ্টিতে এ মোনাজাতের ফায়দা (সুফল, লাভ, উপকার) পাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা কতটুকু কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজকর্মে ধর্মের প্রায়োগিকতা কতটুকু, তা আমাদের সম্মানিত তাবলিগি আলেমরা (অতিশয় বিজ্ঞ ও জ্ঞানীরা) ভালো জানেন। আবার অনেকেই প্রথম দিন থেকেই অনেক কষ্ট স্বীকার করে পুরো বয়ান শোনেন এবং জামাতে নামাজ আদায় করেন। আমার অনেক পরিচিতজন পবিত্র জুমার দিন ভোরে পৌঁছে ফজরের নামাজে শরিক হন। সারা দিন মাঠে থাকেন, নামাজ আদায় করেন, বয়ান শোনেন। রাতে এশার নামাজ শেষে বাড়িতে ফেরেন। এভাবে খোদার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরও পারলৌকিক প্রাপ্তি নিশ্চয় অনেক বলে আমরা গণ্য করি। আমরা আল্লাহর নিয়ম-কানুন মোতাবেক সারা বছর কর্ম কতটুকু করি, তা বিবেচনা না করে শুধু বছরের ওই একদিন দোয়া অর্জন এবং নিজের ও মুসলিম উম্মাহর মাগফিরাতের (ক্ষমা, নিষ্কৃতি) জন্য ইজতেমার মাঠের দিকে ছুটি। আমাদের কালিমা মাখা কাজের ও চিন্তা-চেতনার জন্য বয়ান ও মোনাজাতের মাধ্যমে কতটুকু ক্ষমা অর্জন করি, তা জগৎবিধাতাই ভালো জানেন। তবু আমরা ক্ষমা অর্জন করেছি ভেবে সান্ত্বনা ও তৃপ্তি অনুভব করি। এটাইবা কম কিসের!

আমার দেখা অনেক উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী খোদাভীরু ব্যক্তি তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে ধর্ম পালন করেন। মানুষকে তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানান। তাদের বয়ান শুনলেই বোঝা যায় তারা উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ-পেশাজীবী। তাদের অনেকেই পেশাগত দায়িত্ব পালনে যত্নবান, সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ। তাদের সঙ্গে অনেকেই আছেন, যারা লেখাপড়া তেমন একটা জানেন না, কিন্তু কুরআন পড়তে পারেন। কিছু মাসআলা-মাসায়েল, দোয়া শিখে মাসের পর মাস তাবলিগ জামাতের সঙ্গে ঘোরেন। নামাজ, রোজা ও তাবলিগ জামাতের সঙ্গে থেকেই পরকালে জান্নাতের আশা করেন। আমার বড্ড জানার ইচ্ছা, উচ্চশিক্ষিত ভাইয়েরা তাদের সঙ্গী-সাথীদের ‘দ্বীন-প্রচারে’ দীর্ঘদিন ধরে দীনের কোন্ কোন্ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাদেরকে দীনের কী শিক্ষা দেন। দুনিয়ার কোন্ কোন্ কাজকে দীনের কাজ বলে গণ্য করেন। আমার জানামতে, তাবলিগ জামাতে দীনের আনুষ্ঠানিকতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ দ্বীন একটা ‘জীবন-বিধান’। দুনিয়ার জীবনকর্মকে বাদ দিয়ে ইসলামের ‘জীবন-বিধান’ নয়। ‘জীবন-বিধান’ মোতাবেক চিন্তা ও কাজ করলে পরকালে মুক্তি পাওয়া যায়। সোজাসাপটা কথা হলো, পরকালে দুনিয়ায় করা কাজের হিসাব হবে। এ কাজ মানে শুধু নামাজ-রোজা নয়, জীবনযাপন, রুজি-রোজগার ও দুনিয়াদারির কর্ম। এগুলো বলতে শিক্ষাদীক্ষা অর্থাৎ সার্বিক বিষয়ে জ্ঞানার্জন; সন্তান প্রতিপালন ও তাদের সুশিক্ষা; সৎ পেশা ও সৎ উপার্জন; ভালো কাজে সম্পদ ব্যয়; প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন; দুনিয়াকে মানুষের বসবাসযোগ্য করার জন্য অবদান রাখাসহ সমাজকল্যাণকর সব কাজকেই বোঝায়। দুনিয়ার জীবনে প্রতিটি কাজকর্মে, চিন্তাভাবনায় এ বিধান প্রয়োগ করলে সুষ্ঠু-সুন্দর জীবন গড়ে ওঠে; সমাজজীবন শান্তিতে ভরে যায়। পরিবেশ সুনিশ্চিত হয়। বিধিসম্মত প্রতিটি কাজই ইবাদতে রূপ নেয়। মানুষ-সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধিত হয়। তাবলিগ জামাত মুসলমানদের একটি সুগঠিত, স্বেচ্ছাসেবী, সুশৃঙ্খল অংশ, যারা দ্বীনের কাজে নিজের সময় ও অর্থ ব্যয় করে থাকেন। যদিও তারা ‘দ্বীন’ বলতে কী বোঝেন তা আমার জানা নেই। তাছাড়া আমার পরিচিত অনেক শিক্ষিত তাবলিগি ভাইকেও প্রশ্নটা করেছি, তারাও পূর্ণাঙ্গ কোনো ধারণা দিতে পারেন না। অনেকেই তাদের ‘মুরব্বি’দের নির্দেশনা মতো তাবলিগ জামাতে দল বেঁধে চলেন। মুরব্বিদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। নিজে অনেক কিছুই বিচার-বিশ্লেষণ করেন না।

এভাবে তাবলিগ জামাতের অসংখ্য ধর্মভীরু মুসলমান দেশ-বিদেশে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে ধর্মপ্রচারের কাজে মন দিয়েছেন। তাদের অনেকেই আমার ঘনিষ্ঠ, আমার শ্রদ্ধেয়। তাদের হাত ধরে দেশ-বিদেশের বহু অমুসলিম প্রতিনিয়ত মুসলমান হচ্ছেন শুনি। সমাজের অনেকে তাদের পথ অনুসরণ করে নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত ও তসবিহ-তিলাওয়াতের কাজে রত হয়ে পরকালের পথে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন। আনুষ্ঠানিক ইবাদতের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য-শিক্ষা, জীবন-জীবিকা-কর্ম, সমাজ গঠনকে উপেক্ষা করে চলেন। তাদের অনেকেরই চিন্তা-চেতনা ও কর্মে গোঁড়ামি, একদেশদর্শিতা লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ প্রতিপালকের সৃষ্টিকর্ম, দুনিয়াদারি, সৃষ্টির সেবা, জীবনকর্ম, মানবকল্যাণ ও পেশাকে অলীক-অসার ভেবে নিষ্কর্ম থাকেন। যুগ যুগ ধরে তারা সমাজে সুশিক্ষা, ন্যায়নিষ্ঠা, হতদরিদ্র মানুষের জন্য সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন, আর্ত-মানবতার সেবা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষিত সমাজ গঠন, ন্যায়-কাজের আদেশ ও সত্য কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, এসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। তাদের সুশিক্ষিত অংশ এসব বিষয় ভেবে দেখতে পারে। আমার বিশ্বাস, এগুলোও দ্বীনের কাজ, ‘দ্বীনের খেদমত’ ও ‘হক্কুল ইবাদ’-পরকালের পাথেয়। এগুলোকে বাদ দিলে ধর্ম থাকে না। সমাজেও শান্তি থাকে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। তাবলিগি ভাইদের দুনিয়াবিমুখ অংশ ও সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সুশিক্ষা, ন্যায় কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানানো, দুস্থ সহায়তা ও দরিদ্র-মানবতার সেবার জন্য ‘শিক্ষা-সেবা সমাজের’ একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে আনতে পারলে সমাজ নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে, সুশিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে তাদের পরকালের মুক্তিও মিলবে। এ বিষয়ে আমি তাবলিগ জামাতের শিক্ষিত অংশের কাছে আবেদন জানাতে চাই; তাদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। তাদের কাজের আওতাকে মানুষের কল্যাণে সম্প্রসারিত করতে বলি।

আমি এমন তাবলিগ জামাত চাই, যে জামাত তাদের বর্তমান কাজের পাশাপাশি সমাজের অদূরদর্শী, আত্মবিনাশী, পথহারা খণ্ডিত শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম ও অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়ে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষায় ফিরিয়ে আনবে। ব্যবসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক ইন্টিগ্রেটেড ও ইউনিফায়েড শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলবে। ইহকালের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অর্থের সদ্ব্যবহার, সুশিক্ষা, কর্ম, পেশাগত দায়িত্ব পালনও যে ধর্ম ও ইবাদতের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা মানুষকে বোঝাবে। প্রত্যেক মানুষেরই ধর্ম ছাড়াও সমাজে আলাদা একটা মর্যাদাশীল পেশা থাকতে হবে, তা বোঝাবে। এ মর্যাদাশীল পেশাও যে ধর্ম-কর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা বোঝাবে। সামাজিক সুশিক্ষা ও ‘মানুষের খেদমত’ যে আসলে একটি মানবসেবা, যার জন্য পরকালে তারা মুক্তি পাবে, তা শেখাবে। তাদের মধ্যকার গোঁড়ামি, অকর্মণ্যতা দূর করবে। পুরো জনগোষ্ঠীকে ছোট ছোট নিয়ন্ত্রণযোগ্য অংশে ভাগ করে শিক্ষা, শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সুশিক্ষিত, সুপ্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করবে। আর্ত-মানবতা ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আর্থিক সেবা দেবে। নিঃস্বার্থভাবে সাধারণ মানুষকে সুশিক্ষার দিকে ডাকবে, প্রয়োজনে অনানুষ্ঠানিক সুশিক্ষা দেবে। সমাজের সব জনহিতকর কাজ সাধ্যমতো করবে। সম্পদশালী মানুষ অকাতরে মানুষের কল্যাণে সম্পদ দান ও ব্যয় করবে। দেশে মানুষের মতো মানুষের বসবাস বাড়াবে। এসবই কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা, যা ধর্মপালনের মূল কাজ। অথচ এসব থেকে ক্রমেই আমরা বাদ পড়ে যাচ্ছি। আমরা ক্রমান্বয়ে আত্মকেন্দ্রিক, আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব ধর্মাচারী হয়ে উঠছি। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ‘জীবন-বিধান’ উপেক্ষিত হচ্ছে। আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছি। সবই বাস্তবতা। অথচ কোনো ধর্মই তা চায় না। আমরা ধর্মব্যবস্থাকে, ধর্মাচারকে জীবনের কাজে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পরিকল্পিত ও সফলভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। যদিও সমাজের এসব কাজও প্রত্যেক ধর্মাচারী ও তাবলিগি ভাইদের জন্য সদকায়ে জারিয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার এ চাওয়া নিশ্চয়ই অতিশয়োক্তি কিছু নয়। বিষয়টি আত্মজিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলে বর্তমান অস্থির-দিশাহারা সমাজ আলোর দিশা পাবে, সামাজিক শিক্ষা বাড়বে, জাতীয় উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।

ড. হাসনান আহমেদ : অধ্যাপক, ইউআইইউ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম