Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট গ্রন্থাগার

Icon

এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট গ্রন্থাগার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে চারটি জিনিস প্রয়োজন-১. স্মার্ট সিটিজেন (চৌকস নাগরিক) ২. স্মার্ট ইকোনমি (চৌকস অর্থনীতি) ৩. স্মার্ট গভর্নমেন্ট (চৌকস সরকার) এবং ৪. স্মার্ট সোসাইটি (চৌকস সমাজ)। স্মার্ট সিটিজেনের চারটি গুণ থাকতে হবে-বুদ্ধি, দক্ষতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সৃজনশীলতা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও থানা/উপজেলা পর্যায়ে গণগ্রন্থাগারের বিস্তার ঘটেনি, ইউনিয়ন তো দূরের কথা। অবকাঠামো ও বৈষয়িক উন্নতিতে আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য পেলেও মানসিক উৎকর্ষে পিছিয়ে আছি। ‘দিন বদলের হাতিয়ার, হতে পারে গ্রন্থাগার’-একথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। গ্রন্থাগার হতে পারে সব সাংস্কৃতিক-মানসিক উন্নয়নের ‘প্রাণকেন্দ্র’, যার তাৎপর্য অনুধাবনে আমরা ব্যর্থ। সময় এসেছে, প্রতিটি গ্রামে গ্রন্থাগার বিনির্মাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের। প্রসার ঘটাতে হবে জ্ঞানচর্চার, এর কোনো বিকল্প নেই।

বছর ঘুরে এসেছে ৫ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। এবার জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট গ্রন্থাগার, স্মার্ট বাংলাদেশ’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো একযোগে দিবসটি উদযাপন করে থাকে।

অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) ‘একাডেমিক’ বা ‘শিক্ষায়তন’ গ্রন্থাগার চালু হয়েছে, তবে সব প্রতিষ্ঠানে নয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নামকাওয়াস্তে, বাস্তবে কার্যক্রম নেই। সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে বহু প্রতিষ্ঠানে এর সত্যতা মিলবে। দেখা যাবে, গ্রন্থাগার ব্যবহার করা হচ্ছে গুদাম ঘর বা পিয়ন-দারোয়ান-গার্ডের থাকার কক্ষ হিসাবে। কিছু বই হয়তো আছে, কিন্তু রাখা হয়েছে টয়লেটের পাশে করিডোরে। গ্রন্থাগারিক আছেন, তিনি ব্যস্ত অন্য শিক্ষকের প্রক্সি ক্লাসে কিংবা তাকেও হয়তো ‘ক্লাস’ দেওয়া হয়েছে। ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষিত।

ভুলে গেলে চলবে না, পাঠক তৈরির প্রধান ক্ষেত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই একাডেমিক গ্রন্থাগার চালু ও কার্যকর রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থাগারিকের উপযোগিতা উপলব্ধি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দশম) ও উচ্চ মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) স্তরে সহকারী গ্রন্থাগারিক/ক্যাটালগারের পদ সৃষ্টি করা হয়। পদটি এমপিওভুক্ত। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সমমানের ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় এ পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হচ্ছে না। অর্থাৎ ‘পাঠক’ তৈরি হচ্ছে না। আমরা এ স্তরে গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।

গ্রন্থাগারিকরা নিজেদের পদটিকে ‘জুতসই’ মনে করেন না। তাদের বক্তব্য-প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকর্মী ও সাধারণ মানুষ গ্রন্থাগারিককে যথাযথ সম্মান করে না। তাই তারা হীনম্মন্যতায় ভোগেন। দাবি তোলেন পদবি পরিবর্তনের। আন্দোলনেও নামেন। সরকার দাবি মেনে নেয়। ২০২১ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় নতুন পদবি দেওয়া হয় ‘সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান)’। এতে সুবিধা হলো, গ্রন্থাগারিকরা লাইব্রেরির কাজ না করে বছরব্যাপী অন্যান্য বিষয়ের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কমিটি বা প্রতিষ্ঠানপ্রধান তাদের ‘শ্রম ও মেধা’ ভিন্ন কাজে ব্যবহার করে অপচয় করেন। বিষয়টি দেখার কেউ নেই।

পুরস্কার হিসাবে বইয়ের জুড়ি নেই। এ কথা আমরা জানি, কিন্তু মানি না। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসাবে বই প্রদানের তাগিদ দিয়েছে সরকার। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপনেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এক হাজার গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার ঢাকা জেলার বাড্ডা থানার বর্তমান ডিএনসিসি ওয়ার্ড নং ৪২ (বেরাইদ)কে ‘পাইলট প্রকল্প’ ধরে কাজ করছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনের আগে থেকেই এখানকার স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজে ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ সাবজেক্ট রুটিনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে তিনটি মডেল গ্রন্থাগার গড়ে তোলার কাজ চলমান।

বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো টেকসই করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে তিনটি দাবি পেশ করে : ১. বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো ক, খ ও গ শ্রেণিভুক্ত করে স্থায়ী মঞ্জুরির আওতায় আনা। গ্রন্থাগারিক পদ সৃজন ও এটি এমপিওভুক্ত করে মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিকের সমান বেতন স্কেল প্রদান; ২. অনুদান প্রদানে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ চালু করা; ৩. অনুদান কমিটিতে বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি। জ্ঞানভিত্তিক, আলোকিত ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে এর বিকল্প নেই।

‘জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি’ ২০০১ সালের ২৮ মে অনুমোদিত হয়। সে সময় বাংলাদেশ ছিল স্বল্পোন্নত দেশ। এখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে। উন্নত দেশের সারিতে উন্নীত হওয়া এখন আর স্বপ্ন নয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ গড়াটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একমাত্র পরীক্ষিত পথ জ্ঞাননির্ভর, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক একটি সমাজ গড়ে তোলা। আর এ ক্ষেত্রে মানবসভ্যতার বিকাশের সূচনালগ্ন থেকে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি দেশ। দেশের এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রন্থাগারের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার বিকাশে, সর্বস্তরের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় এবং জনগণের জীবনব্যাপী স্বশিক্ষায় সহায়তা প্রদানে, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, অর্জিত শিক্ষার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, কূপমণ্ডূকতা ও কুসংস্কারের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক চেতনা মুক্তচিন্তার বিকাশে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের জন্য নিবন্ধিত বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করেছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এর মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত লোগো ও স্লোগানসংবলিত ব্যানার স্থাপন (আবশ্যিক), বই পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে র‌্যালি (শোভাযাত্রা), বই পড়া কর্মসূচি এবং পাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন।

এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার

emdadhb@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম