দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরাল অবস্থানই কাম্য
মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) সর্বশেষ ধারণাসূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান আরও এক ধাপ খারাপ হয়েছে। তাদের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এ দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১২। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ টিআই ধারণাসূচকের অন্তর্ভুক্ত হয়।
এমন সময়ও গেছে, যখন তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছে এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে-যেটি এখন হয়তো সোমালিয়া, সুদান কিংবা সিরিয়া। এ রিপোর্ট অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছরেও বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়নি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতির দিক দিয়ে আমাদের অবস্থা আগের মতো নয়। আবার আগের মতো না হলেও টিআই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ খারাপভাবেই উঠে আসছে। দুর্নীতির দিক দিয়ে এ দেশে অবস্থার উন্নতি চোখে পড়ছে না তাদের।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবি প্রধান যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে তিনি বছরের পর বছর প্রকাশিত নিজেদের ধারণাসূচক বা রিপোর্ট নিয়ে সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, স্বীকৃত নিয়ম অনুযায়ী দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করেই তারা সূচক তৈরি করেন, যাতে বাংলাদেশ এবার গতবারের তুলনায় আরও এক পয়েন্ট কম পেয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ রয়েছে কেবল আফগানিস্তানের উপরে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পারফরম্যান্স যথেষ্ট খারাপ বলেই মনে করেন তারা।
আমি এ বিষয়ে গবেষক নই। এ ধরনের গবেষণায় জড়িত থাকার কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। টিআই প্রকাশিত ধারণাসূচকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরাসরি কোনো বক্তব্য দেওয়া আমার দিক থেকে সঙ্গত হবে না। তবে এটুকু সাধারণভাবেই বলা যায়, সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখানে দুর্নীতির ব্যাপকতা অস্বীকার করা যাবে না। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে জরিপ চালালে এতটা খারাপ পরিস্থিতি হয়তো উঠে আসবে না। তবে পরিস্থিতি সুখকর হবে বলেও হলফ করে বলতে পারি না।
প্রথম কথা হলো, কোনো দেশই পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত নয়। টিআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব দেশ কম দুর্নীতিগ্রস্ত বলে প্রচারিত হয়ে আসছে, তারাও একসময় হয়তো এমন অবস্থানে ছিল না। উপনিবেশবাদের যুগে এদের কোনো কোনোটি পররাজ্যগ্রাসী হয়েছিল এবং তখন তারা হেন অপরাধ নেই, যা করেনি। আমরাও প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিলাম। প্রথমে ছিলাম তাদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন। বণিকের দণ্ড পরবর্তীকালে রাজদণ্ড হয়ে উঠেছিল। আমাদের মতো অনেক দেশ ও অঞ্চল এসব ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা শোষিত হয়েছে এবং তাতে ওইসব দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠে। সেটা কেবল দুর্নীতিই ছিল না, বড় অপরাধও ছিল।
তবে এ কথাও ঠিক, ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর আমাদের মতো দেশগুলোয় দুর্নীতির মতো অপরাধ না কমে এলে এবং তা আরও বাড়লে এর দায় নিজেদের ওপরই এসে বর্তাবে। জবাবদিহিমূলক শাসন, স্বচ্ছ প্রশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। এ কাজে অবহেলা করে যাওয়ার বা সে দায়িত্ব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে ধারণাসূচক তৈরি করে প্রতি বছর, তাতে নিজেদের অবস্থান খারাপ এলেই তাকে ঢালাওভাবে বাতিল করে দেওয়াও উচিত নয় বলে আমি মনে করি। তাদের প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো বরং প্রয়োজন। সরকার নিজেও নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে অন্তত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি কতটা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে পারে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রতিবার প্রতিবেদন প্রকাশের সময় টিআইবি দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য কিছু সুপারিশ দিয়ে থাকে। এসব সুপারিশের কথা যে অন্যদের বা সরকারের অজানা, তা কিন্তু নয়। দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তাও নয়। দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে কমিশনে রূপান্তর করা হয়েছে এবং সেজন্য আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে, যার আওতায় নিশ্চিত হয়েছে এর স্বাধীনতা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রতিষ্ঠান বা কিছুই করছে না, তাও বলা যাবে না। তবে এ প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চয়ই আরও কার্যকর করে তোলা সম্ভব। দুদক নিজেও দুর্নীতি দমনে আরও উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে এবং তাতে সরকার নিশ্চয়ই বাদ সাধবে না।
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও প্রশাসন গড়তে গণমাধ্যমের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে এখন অনেক ধরনের মিডিয়া এবং এর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, এ অভিযোগ করা যাবে না। নিজেরা স্বচ্ছ থেকে তারা প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশ করলে সেসব সরকার বিবেচনায় নিচ্ছে না, তাও বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি জিরো টলারেন্স নীতিও গ্রহণ করেছেন, যা নতুন নয়। ক্ষমতাসীন দল, সরকার ও প্রশাসনের যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি পিছপা হচ্ছেন না। মাঝে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। তবে এ কথাও বলতে হবে, তা বেশি দিন সমানভাবে চলেনি ও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা প্রমাণ করে বিচার শেষ করতেও সময় লাগে। এ ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের দক্ষতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। তাদের সততা নিশ্চিত করাও সহজ নয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংসদে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটিগুলোর কার্যক্রমও বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্ব নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, প্রশাসন, রাজনীতি ও সমাজ থেকে দুর্নীতি কমিয়ে আনার দায় কেবল সরকারপ্রধানের ওপর রাখলে চলবে না। তবে তাকেও দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের বাধাগুলো চিহ্নিত করে এগিয়ে আসতে হবে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করায়। বাংলাদেশে তিনি উন্নয়ন নিশ্চিত করেছেন টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে। অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে দেশে এবং সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এর পাশাপাশি দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশের অবস্থান উন্নত না হলে এবং সেটা নিশ্চিত করা না গেলে তা হবে দুঃখজনক।
উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়ে, এটাও স্বীকার করতে হবে। অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গেও দুর্নীতি বাড়ে। দুর্নীতির আকার দেখে তাই ঘাবড়ানো যাবে না। তবে এটা যাতে নিয়ন্ত্রণে তথা অন্তত সীমার মধ্যে থাকে, সেদিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। যেসব দেশ অভ্যন্তরীণভাবে দুর্নীতিমুক্ত বলে পরিচিত, সেসব দেশের প্রতিষ্ঠান যখন আমাদের মতো দেশে ব্যবসা করতে আসে, তখন তাদেরও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তারা আমাদের মতো দেশে চলমান দুর্নীতির সুযোগ নেয়; আবার এখানকার প্রশাসক ও পেশাজীবীদের আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্তও করে তোলে।
কাজ না পেলে বা রাজনৈতিকভাবে বিরুদ্ধপক্ষ হলে কিংবা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেও তারা অনেক সময় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে থাকে। দেশের বৃহত্তম প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ তুলেছিল বিশ্বব্যাংক, যা তারা প্রমাণ করতে পারেনি। আবার এ কথাও ঠিক, কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থা প্রকল্পে যুক্ত থাকলে নজরদারি বাড়ে এবং তাতে দুর্নীতি কমে আসে। তবে নিজ দেশে দুর্নীতি কমিয়ে এনে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রধান দায়িত্ব সে দেশের সরকারেরই। সরকার প্রশাসন চালায়, সুতরাং প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার দায়ও সরকারের। প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত যতটা করা সম্ভব হবে, ততই তাকে জনকল্যাণে নিবেদিত করা যাবে। প্রশাসনে দুর্নীতি কমে এলে এর প্রভাব সমাজেও পড়বে।
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বেসরকারি খাত অনেক দিন ধরেই প্রাধান্যে আছে। তাদের মধ্য থেকেও এমন অভিযোগ মাঝেমাঝে উঠে আসে যে, পদে পদে দুর্নীতির কারণে তারা ঠিকমতো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না। প্রশাসন তাদের সহায়তার বদলে হয়রানি করছে, বিপুল অঙ্কের ঘুস দিতে হচ্ছে বলে তাদের ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা কিছু দিন আগেও অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সহায়তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ। সেখানে ব্যবসায় যেসব বাধাবিঘ্নের কথা উঠে এসেছে, তার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি প্রধান। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা পরিচালনাকারীরা এমনটাই মনে করেন। এ ধরনের জরিপ প্রতিবেদনে সামগ্রিক চিত্র কতটা উঠে আসে, সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। তার পরও এদের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, বরং বিবেচনায় নিতে হবে। দুর্নীতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় বাড়লে পণ্যসামগ্রী ও সেবার দাম বেড়ে যায় এবং সেটা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর গিয়ে পড়ে। এতে আবার সরকারের ভাবমূর্তি খারাপ হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাকারীরা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছেন, সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। তাদের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষের কম অভিযোগ নেই। তারাও সংঘবদ্ধ হয়ে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ বানচাল করে দেয়। সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায়ে তাদের সবাইকে পিছিয়ে থাকতে দেখা যায় না। পরিস্থিতির সুযোগ তারাও নিয়ে থাকে। অন্য পেশাজীবীদের মধ্যেও অস্বচ্ছভাবে জীবনযাপনের প্রবণতা তীব্রভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। পাল্লা দিয়ে অসৎ হওয়ার চেষ্টা যে সমাজে প্রবল, সেখানে দুর্নীতি কমিয়ে আনা কঠিন।
যেমন, দেশের ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা যেভাবে বেড়েছে, তা কখনোই এত মারাÍক হয়ে উঠত না-ব্যাংকাররা দায়িত্বশীল হলে। দেশ থেকে অর্থ পাচারও এত বাড়ত না-সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে। তবে শেষ বিচারে দুর্নীতি না কমলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বেড়ে উঠলে এর দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে। সামনে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আছে বলেও টিআই সূচকে আমাদের অবস্থান যাই থাকুক-সরকারপ্রধানকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান আরও জোরাল করতে হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক; লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর