Logo
Logo
×

বাতায়ন

ওরা অরক্ষিত

Icon

লে. কর্নেল (অব.) মো. সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওরা অরক্ষিত

বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ৫ বছরের মতো; তাই বাবাকে ভালোভাবে মনে নেই। বাবার আদর-সোহাগ কি পেয়েছি, তা-ও মনে নেই। মা-ই আমাদের সব ছিলেন, তিনিও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বছর কয়েক আগে। আমি সামরিক জীবন কাটিয়ে অবসরে এসে এখন বেসামরিক একটি কোম্পানিতে জিএমের (সিকিউরিটি) কাজ করছি।

আমাদের প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড় এবং প্রতিনিয়ত নানাবিধ নির্মাণকাজ চলছে। এ কর্মযজ্ঞ করতে গিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে বেচে যাওয়া রডের টুকরো ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী জমা হচ্ছে। এ বেচে যাওয়া রডের টুকরোর ওপরই পড়েছে টোকাই বা পথশিশুদের নজর।

প্রায়ই প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে ওরা ধরা খাচ্ছে, আবার কখনো কখনো পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। যারা ধরা পড়েছে, তাদের সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। কী নিদারুণ তাদের সে জীবনের গল্প। চোখে জল এসে যায়। এদের করুণ কাহিনি শুধু দুঃখের। দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয় ওরা-জন্ম থেকে সে কষ্টের শুরু।

একবার একজনকে রডসহ ধরে আমার কাছে নিয়ে আসা হলো। সে কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করলে বলল, মা বেঁচে আছেন, টঙ্গীতে থাকেন, আর বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি জানতে চাইলাম, তুমি কোথায় থাক? টঙ্গীতে। উত্তরে সে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সামনের ফুটওভারব্রিজ দেখিয়ে বলল ওটার ওপর। বললাম, মার কাছে যাও না? উত্তরে বলল, মা কোথায় থাকে জানা নেই। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মায়ের কাছেই বড় হয়েছি। মাকে জড়িয়ে ধরে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করেছি বহুবার। ডিউটি শেষ করে ঘরে ফিরলেই বৃদ্ধ মা খাটে শুয়ে শুয়ে বলতেন, বাবা খেয়েছো? মাকে জড়িয়ে ধরার সে প্রশান্তির সুখ ও সে মধুর কণ্ঠ আমি আর শুনতে পাই না। শিশুটির কাছে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে বিষাদের মেঘের গর্জন আর আফ্রিকার বালুর ঝড়ের মতো আসতে লাগল। আমি দুঃখ-কষ্টের সে বালুঝড়ে উটের মতো মাথা নিচু করে লুকাতে চাচ্ছিলাম। আমার লজ্জা, ভয়, কষ্ট এবং বাবা-মা, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে শুধুই জিজ্ঞাসা-এরকম শিশুর কী অপরাধ?

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নেশা করো? মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ। কী নেশা করো? ডেন্ডি খাই। আমরা অনেকেই জানি, বাংলাদেশের সবচেয়ে সহজলভ্য ও সস্তা নেশার উপকরণ এটি। টায়ার বা টিউব ছিঁড়ে গেলে জোড়ার সলিউশন এটি। খুবই সস্তা, তাই এ অবুঝ শিশুদের নেশায় বুঁদ হওয়ার জন্য একটি চরম উপকরণ। এ সলিউশন একটি পলিথিনে নিয়ে বারবার মুখ ঢুকিয়ে শুধু শুঁকে নিলেই নেশাগ্রস্ত হওয়া যায়।

প্রতিদিনের আয় ও ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন করলে সহজ উত্তর-স্যার, ২০০-৩০০ টাকা হলেই হয়ে যায় সারা দিনের খাবার ও নেশা। জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে আসে ২০০-৩০০ টাকা? চুরি করে। কী চুরি করো? যা পাই তাই। তবে ভাঙারির দোকানে যা যা বেচা যায়, তা-ই ওদের কাছে মূল্যবান। বললাম, চুরি করতে না পারলে সেদিন কেমনে চলে? সোজা উত্তর-না খেয়ে থাকি স্যার। তবে চেয়ে চেয়েও কিছু খাবার মাঝেমধ্যে পাই।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা এ শিশুদের ঘর নেই, খাবার নেই, মা নেই, বাবা নেই, সামাজিক নিরাপত্তা নেই, রাষ্ট্রীয় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই, রাজনীতিকদেরও কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ওদের জীবনে কোনো সুখ নেই। অরক্ষিত এ পথশিশুদের পাশে দাঁড়ানোর বুঝি কেউ নেই।

পথশিশু বা টোকাইদের আমাদের সমাজে রয়েছে নানা কদর। মিটিং-মিছিলে লোক দরকার-একটা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে ওরা হাজির হয়ে যাবে। টাকার সঙ্গে খাবার পেলে ওরা আরও বেশি কিছু করে দেবে। পথশিশুরা টাকার বিনিময়ে রাস্তায় যে কারও সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে পিছপা হয় না। ওরা টাকা পেলে ইটপাটকেল-ঢিল ছোড়া থেকে শুরু করে ককটেলও মারতে পারে প্রতিপক্ষকে। সমাজের কাছে নিগৃহীত হতে হতে ওরা ভুলেছে লাজ-লজ্জা, হয়েছে নেশাগ্রস্ত আর হারিয়ে ফেলেছে বিবেকবোধটুকু। তাই সমাজের একটা শ্রেণির লোকজন নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে ওদের ব্যবহার করছে দিনের পর দিন। ওরা মাদক কারবারিদের কাছে খুবই বিশ্বস্ত; কারণ, ওদের দিয়ে খুব অল্প পয়সায় মাদক বহন ও বেচাকেনা করা যায়। সমাজে মেয়ে পথশিশুদের ভাগ্য আরও নির্মম, নিষ্ঠুর-সে কথা আজ আর নাইবা লিখলাম।

টোকাইদের যারা অযথা না বুঝে গালাগাল দেন, তাদের বলছি-সংযত হোন, নিবৃত হোন। সমাজের অনেক ছবি ও বাস্তবতার মাঝে ওরাও একটি অংশ। দেশের বৃহৎ ছবিটির রং না লাগা অংশে রং করুন, ছবিটি সুন্দর দেখাবে-টোকাইদের প্রতি আপনিও যত্নবান ও দায়িত্বশীল হোন।

পথশিশুদের গল্পের যেন শেষ নেই। একবার এক পথশিশু রড চুরির অপরাধে ধরা পড়ল। আমি এ ধরনের শিশুদের মারার পরিবর্তে ভয়ভীতি দেখাতেই পছন্দ করি, যাতে ওরা আমাদের প্রতিষ্ঠানে না আসে। ওরা ধরা পড়লে পুলিশকে দিতে চাইলে বয়স কম হওয়ায় পুলিশ নিতে চায় না। অনেক কষ্ট করে যদিও পুলিশকে দেওয়া হয়, তবে শুনেছি এসব শিশুক মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা।

ফিরে আসা যাক সেই রডসহ ধরা পড়া শিশুটির কথায়। তাকে ধরার পরপরই সে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে লাগল। অগ্যতা তাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলাম। আরেকদিন আরেকটি শিশুকে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর খবর পেলাম সে নাকি ব্লেড দিয়ে নিজের হাত-পা কাটতে শুরু করে দিয়েছে-রক্ত ঝরছে। তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিলাম। ওর রক্তক্ষরণের যন্ত্রণা আমরা কজন জানি বা বুঝি? আমাদের দেশের কজন মানুষের এ রক্তক্ষরণ দেখার সুযোগ হয়েছে? ওরা অবুঝ; প্রকৃতি নয়, আমরাই ওদের এভাবে রক্তক্ষরণে বাধ্য করেছি। বাবা বা মা নিজ সন্তানকে এভাবে ছেড়ে তখনই দেয়, যখন তাদের নিজেদের কিছুই করার থাকে না। যেখানে ব্যক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, ব্যক্তি বা পরিবারের কিছুই করার থাকে না; সেখানে সমাজ এগিয়ে আসে-সমাজকে তার নানা সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এ অরক্ষিত পথশিশুদের আগলে রাখতে হয়। সমাজের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও অনেক কিছু করার আছে। রাষ্ট্র হয়তো অনেক কিছুই করেছে, তবে সেগুলোর প্রভাব পথশিশুদের বেলায় কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা ভেবে দেখার বিষয়। পথশিশুর রক্তক্ষরণ আমাদের হৃদয়কে যদি দোলা না দেয়, বিবেকে যদি প্রশ্ন না তোলে, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ না ঘটায়, তবে কে ওদের রক্ষা করবে? ওদের এ রক্তাক্ত পথচলা, রাস্তার ফুটওভারব্রিজে কনকনে শীতের মধ্যে শুয়ে থাকা, অভুক্ত রাত্রিযাপন, বাবা-মার আদর থেকে বঞ্চিত এ শিশুরা এ দেশের মাটিতেই জন্মেছে, ওরা আমাদেরই কারও না কারও সন্তান। ওদের সুরক্ষিত করার দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। এ শিশুদের পথশিশু অথবা টোকাই যে নামেই ডাকুন না কেন, ওরা অরক্ষিত। ওদের অরক্ষিত রেখে এ দেশ সুরক্ষিত হতে পারে না।

মো. সাইফুল ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

mdsaifulislam99@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম