Logo
Logo
×

বাতায়ন

চাকরির বাজারে অচল শিক্ষা

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চাকরির বাজারে অচল শিক্ষা

প্রতীকী ছবি

অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে আমাদের দেশের শতকরা ৭১ ভাগ শিক্ষার্থীর পড়াশোনার খরচের জোগান দেন তাদের অভিভাবকরা। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ হার অনেক অভিভাবককে অসহায় করে তোলে। কারণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে প্রতিমাসে অভিভাবকের পাঠানো টাকার জন্য হা করে চেয়ে থাকে। অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই বর্তমান চাকরির বাজারে অচল উচ্চশিক্ষা গ্রহণে রত। অথচ আমাদের দেশীয় চাকরির বাজারে হাজার হাজার টেকনিক্যাল পদ দখল করে আছে ভারত, চীনসহ নানা দেশের নাগরিকরা। সে কথা আমাদের শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা অনেকেই ভালোভাবে জানেন না।

নির্ভরশীল এসব শিক্ষার্থী পাশ করার পর তাদের প্রায় সবাই শহরে থাকতে পছন্দ করে। বড় চাকরি পেতে চায়। অনেকে গ্রামে ফেরত যেতে অনীহ। এমনকি অনেকেই ভালো চাকরি পেলেও রাজধানী ঢাকা অথবা বিভাগীয় শহরের বাইরে চাকরি করতে যেতে চায় না। কেউ কেউ একবার শহরে এসে আর গ্রামের বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতে চায় না। কারণ, আমাদের দেশে গ্রাম ও শহরের নাগরিক সুবিধাদির মধ্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। এ ফারাক দিনদিন আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। এখনো উচ্চশিক্ষা হোক বা বড় কোনো রোগের চিকিৎসার প্রয়োজন হোক অথবা কোনো চাকরির ইন্টারভিউ হোক, ঢাকা শহরে না গেলে তার উপায় বা বিকল্প কোনোটাই থাকে না। একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, বিয়ের শাাড়ি-গহনা কিনতে বা হাইকোর্টে মামলার হাজিরা দিতেও ঢাকায় আসতে হয়। মার্কেটের ছাদে গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও সেগুলোর আবাসিক হল। এভাবে ঢাকা হয়েছে জনবহুল, গাড়িবহুল, শব্দবহুল, দূষণবহুল, মশকবহুল, জলজট-যানজটে নাকাল বিশ্বের ১ নম্বর বসবাসের অনুপযোগী শহর।

এ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টার কমতি নেই। খরচেরও কমতি নেই। আর তাতে এটি হয়ে উঠছে দালান ও উড়াল সড়কের কংক্রিটের এক ভয়াবহ বস্তি। একটি দালান কাত হয়ে গিয়ে বা বহুতল ভবনে আগুন লেগে একটি রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার ওপর আরও ভারী স্থাপনা নির্মাণের মহাপরিকল্পনা আমাদের কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজরদারি আছে বলে মনে হয় না। কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পে জাপানের কোবে শহরে একটি কংক্রিটের উড়াল রাস্তা উলটে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথা কি কারও মনে পড়ে না? তাই বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে ঢাকাকে আর বেশি ভারাক্রান্ত না করে জাপানের মতো পরিবহণব্যবস্থা করে সব জেলা শহরের সঙ্গে বুলেট ট্রেনের মাধ্যমে কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য মেগা প্রকল্প দ্রুত হাতে নেওয়া দরকার। তাহলে সময় বেঁচে যাবে, দেশের উন্নয়নে ভারসাম্য আসবে এবং সব কূল রক্ষা হবে। এজন্য আমাদের জ্ঞানের লেভেল কোথায় থাকা উচিত এবং সেটা কীভাবে অর্জিত হবে, তা নিয়েও চিন্তা করা উচিত।

যা হোক, আমাদের উচ্চশিক্ষায় এসে একশ্রেণির তরুণ চরম হতাশ। তাদের অচল শিক্ষায় দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়ে মূলত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে অপব্যবহার করা হচ্ছে। এসব তরুণের অনেকেই নেতা হতে চায়। কদিন আগে এক জনসভামঞ্চ উলটে গেলে সেখানকার প্রধান অতিথি আক্ষেপ করে বলেছিলেন কিছু আবেগভরা কথা, যেখানে বেশিসংখ্যক নেতার নেতাগিরি করার ইচ্ছার দৈন্যই ফুটে উঠেছে।

মনে পড়ে, প্রায় ৩০ বছর আগে জাপানের এক ল্যাবে বসে জাতীয় নির্বাচন চলাকালে সেখানকার শিক্ষার্থী বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আজ তোমাদের ভোট হচ্ছে, তোমরা ভোট দিতে যাবে না? তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে অনেকটা অনীহ ছিল। একজন উত্তরে বলেছিল, আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত আগ্রহ নেই। সাড়ে পাঁচ বছর সময়ে সেখানে আমি দেখিনি কোনো মাইকিং, কোনো জটলা বা কোনো বৃহৎ জনসভা। শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য কি না, সেটা তাদের কথা বা আচরণে বোঝার উপায় নেই। রাজনীতির কারণে তারা নিজেদের পড়াশোনা ও ক্লাস ফাঁকি দিতে পারে না।

শুধু একদিন একজন প্রার্থী তার একজন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে বাসার দরজায় এসে ডাকবাক্সে একটি ছোট্ট লিফলেট দিয়ে গেছেন। সেটাও নিঃশব্দে। আরেকদিন একজন প্রার্থী গেটের সামনে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। তার হাতে সাদা গ্লাভস ছিল। তারা আমাদের মতো চেহারার বিদেশিদের স্বকীয় কালচার বোঝেন। সেজন্য হ্যান্ডশেক করেন। কিন্তু সেই প্রার্থী যেহেতেু সেদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন, সেহেতু তার হাত থেকে কোনো জীবাণু যেন ভোটারদের শরীরে সংক্রমিত না হয় সেজন্য প্যাকেট থেকে নতুন ওয়ানটাইম গ্লাভস পরে নিয়েছিলেন! সেটা করোনার বহু আগের কথা। যারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন না, তাদের জন্য ডাকযোগে আগেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের দেশের মতো ভোট নিয়ে ওদের প্রার্থী বা ভোটার কারও মধ্যে এত মাতামাতি বা উত্তেজনা ছিল না।

পিএইচডির আগে পরিবেশ বিজ্ঞানে মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালীন লক্ষ করতাম, আমার কিছু ক্লাসমেট অনেকটা অগোছালোভাবে দ্রুতগতিতে ক্লাসে ঢুকত। লেকচার শুনতে শুনতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু শিক্ষক তাদের কিছুই বলতেন না। একদিন লাঞ্চের সময় ক্লাসে ঘুমানো এক বন্ধুকে বললাম, তুমি মাঝেমধ্যে ক্লাসে ঘুমাও, রাতে ঘুম হয় না নাকি? সে উত্তরে বলেছিল, বন্ধু তুমি তো স্কলারশিপ পাও, সেজন্য বিষয়টা বুঝবে না। আমার জমানো টাকা দিয়ে সেমিস্টার ফি দিয়েছি। আগামী সেমিস্টার ফি দিতে হবে, তাই আমাকে রাতে কাজ করতে হয়। আমার বাবা-মা অথবা অভিভাবকরা কোনো টাকা দেন না। ওদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা পরিবার থেকে টাকা নিতে লজ্জাবোধ করে। তারা সাধারণত নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করে চাকরি করে টাকা জমায়। তারপর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুবছরের মাস্টার্স পড়ে। ওদের দেশে সবাই মাস্টার্স পড়তে যায় না, শুধু যাদের চাকরিক্ষেত্রে প্রয়োজন অথবা একান্ত ইচ্ছা, তারাই বড় ডিগ্রি গ্রহণ করে।

অথচ আমাদের দেশে উলটো। এখানে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শেষ করে চাকরি নেই। তাই বসে না থেকে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মাস্টার্স পড়ে। আরেকটি বিষয় হলো, এখানে এক বছরের গবেষণাবিহীন কোর্সের মাস্টার্স ডিগ্রির প্রচলন রয়েছে। গবেষণাসহ কমপক্ষে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স প্রচলিত নয় আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য সেখানে সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের বড় অভাব।

এভাবে চাকরির বাজারে অচল ও অসম্পূর্ণ শিক্ষায় দীক্ষা দিচ্ছি আমরা। কিছু কিছু বিষয়ে পড়ানো হয়, যেগুলোর জ্ঞান চাকরির বাজারে কাজে লাগে না। অধিকাংশ সরকারি কলেজে সেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। তাদের গবেষণার জন্য ল্যাবে আসতে হয় না। এমনকি পরীক্ষা প্রদানের শর্তের জন্য ক্লাসে উপস্থিতির দরকারও হয় না।

একজন চাকরিদাতা সেদিন বড় আক্ষেপ করে বলেছেন, ধরুন আমি আমার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি বড় পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করেছি। দেখা গেছে, সেখানকার আবেদনকারীদের ৮০ ভাগ এ চাকরির জন্য একাডেমিক ফিট নয়। আরেকটি বিষয় হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন প্রার্থী চাকরিতে যোগদান করতে আসেন, যিনি কোথাও কোনো লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষাই দেননি। অথচ তার হাতে নিয়োগপত্র। এরা স্বজন বা মহারথীদের সুপারিশে নিয়োগপত্র পাওয়া প্রার্থী। তারা একাডেমিক অযোগ্যতা নিয়েও যোগদান করেন এবং অফিস ও প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতিসাধন করেন। এক্ষেত্রে ঘুস-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এতকিছু দেখে বলা যেতে পারে, আমাদের চাকরির বাজারে অচল শিক্ষা ও দীক্ষার ব্যাপক প্রচলন দেশের ভবিষ্যৎকে গহিন অন্ধকারে তলিয়ে দিচ্ছে।

এত জটিল বক্তব্য শুনে মনে মনে ভাবলাম, আমরা কী পড়াই আর ওরা কী পড়ে। আমরা কী বলি আর ওরা কী অনুশীলন করতে বাধ্য হয়। আমরা শ্রেণিকক্ষে শুধু তত্ত্বীয় জ্ঞান দিই। আর চারদিকে প্রচলিত নিষ্ঠুর বাস্তবতায় এই জটিল পরিবেশ ওদের চাকরি পাওয়ার ভাবনায় অস্থির করে তোলে। ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসে অনেকেই বিসিএসে ভিন্ন ক্যাডারকে ১ নম্বর পছন্দ দেয় কেন-সেটাও গভীর চিন্তার বিষয়। চাকরির বাজারে অচল শিক্ষা ও রুটি-রুজি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ দৃশ্যমান অচলায়তন ভাঙবে কবে, কীভাবে?

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর; সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম