কিডনি প্রতিস্থাপন ক্ষেত্রে কিছু জরুরি বিষয়
ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে আরও একটি সাফল্য যুক্ত হলো। কিডনি প্রতিস্থাপনে উন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নামও এখন উচ্চারিত হবে। এ সাফল্য ধরে রাখতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং লজিস্টিক সাপোর্ট জোরদার করতে হবে। কিডনি দান করা নিয়ে আমাদের মাঝে যে সংশয়-বিভ্রান্তি আছে, তা-ও দূর করতে হবে।
যেসব রোগী এন্ড স্টেজ রেনাল ফেলিউরে ভুগছেন, অর্থাৎ কিডনি স্থায়ীভাবে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছে না, তাদেরই কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ রোগীদের অনেক ক্ষেত্রেই ডায়ালাইসিস করা হয়। এ দুটি চিকিৎসাপদ্ধতিকে রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বলে। তবে এদের মধ্যে রেনাল ট্রান্সপ্ল্যানটেশন উত্তম। তবে যাদের কিডনির ডোনার নেই বা আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাদের ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে করণীয় : যিনি কিডনি গ্রহীতা তাকে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ডোনার নিয়ে আসতে বলা হয়। এ ডোনার বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলেমেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচাতো, মামাতো, খালাতো বা ফুফাতো ভাইবোন হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে এ আইনে ডোনারের পরিসীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অনেক দেশে ইমোশনাল ডোনার আছে। অর্থাৎ গ্রহীতার সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নেই, নিছক বন্ধুত্বের কারণে কিডনি ডোনেট করে।
তারপর ডোনারের শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হার্ট ডিজিজ অর্থাৎ কোনো বড় ধরনের অসুখ আছে কিনা তা দেখা হয়। অবশ্যই ডোনারের কিডনি দুটি সুস্থ-সবল আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হয়। তারপর গ্রহীতার সঙ্গে দাতার এইচএলএ ম্যাচিং বা টিস্যু টাইপিং করা হয়। যখন প্রয়োজনীয়সংখ্যক টিস্যু টাইপিং ম্যাচ হয়, তখন ডোনারকে প্রস্তুত করা হয়। এর সময়কাল কিছুটা দীর্ঘ। ডোনার প্রস্তুত হলে গ্রহীতাকে ভর্তি করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এ ম্যাচিং হওয়াটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জিং। অনেক আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ম্যাচিং হতে চায় না, অনেকে আবার ডোনার খুঁজে পায় না। তখন তারা আইনবহির্ভূতভাবে ডোনার খোঁজার চেষ্টা করেন।
অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি : এই টিমে নেতৃত্ব দেন ইউরোলজিস্ট। টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হচ্ছেন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট বা অজ্ঞানকারী চিকিৎসক ও নেফ্রোলজিস্ট। একজন সাইক্রিয়াটিস্ট বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে এই টিমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ, যিনি কিডনি দান করছেন, তা সুস্থ দেহ ও মনে দিচ্ছেন কিনা তা অ্যাসেসমেন্ট করা। এ ছাড়া রোগীদের রোগভেদে গ্যাস্ট্রো এন্টারোলজিস্ট বা পেটের ডাক্তার, কার্ডিওলজিস্টকে ডাকা হয়। আইনগত কমিটির মন্তব্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
পাশাপাশি দুটি অপারেশন থিয়েটারে দাতা ও গ্রহীতা রোগীকে রাখা হয়। প্রথমে ডোনারের অপারেশন শুরু করা হয় এবং তার দেহ থেকে কিডনি বের করে আনার পর পারফিউশন করা হয়। এটি এমন একটি পর্যায়, যেখানে একটি বিশেষ ধরনের ফ্লুইডে কিডনি ও রক্তনালিকে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় এবং এ অঙ্গের তাপমাত্রা একেবারে কমিয়ে আনতে হয়।
তারপর গ্রহীতার শরীরে এটি স্থাপন করে যথাযথভাবে অ্যানাসটোমোসিস বা জোড়া লাগানো হয়। ক্যাডেভারিক বা ব্রেন-ডেথ ব্যক্তির শরীর থেকে যখন কিডনি নেওয়া হয়, তখন যত দ্রুত সম্ভব, সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টার মধ্যে গ্রহীতার শরীরে তা প্রতিস্থাপন করা হলে কিডনি দ্রুত ভালোভাবেই কাজ শুরু করে। ক্যাডেভারিক থেকে কিডনি সংগ্রহের পর তা বিশেষ ধরনের ফ্লুইডে পরিষ্কার করা হয়, যা ব্যয়বহুল। কিন্তু লিভিং বা জীবিত ব্যক্তির কিডনি নেওয়ার পর এ ফ্লুইডের প্রয়োজন হয় না।
কীভাবে একজন কিডনি দান করতে পারেন : যারা মৃত্যুর পর কিডনি দান করতে চান, তারা দুভাবে এটা করতে পারেন। একটি হচ্ছে, যখন তিনি জীবিত থাকবেন, তখন তার ইচ্ছা পোষণ করে যাবেন বা উইল করবেন। আরেকটি হচ্ছে, যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে ব্রেন-ডেথ ঘোষণা করা হয়, তখন তার উত্তরসূরিরা রোগীর পক্ষে কিডনি দানে সম্মতি দিলে সেটাও গ্রহণযোগ্য হবে। সম্প্রতি আমরা একজন ক্লিনিক্যালি ডেথ শরীর থেকে দুটি কিডনি নিয়ে দুজন ব্যক্তির দেহে তা প্রতিস্থাপন করেছি। লিভিং বা জীবিত ব্যক্তি থেকে কিডনি নিতে চাইলে ডোনারের মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী কোনো শারীরিক অসুস্থতা থাকা চলবে না।
সাকসেসফুল অপারেশনের জন্য যা প্রয়োজন : অবশ্যই সার্জন টিম ও ইউরোলজিস্টদের পর্যাপ্ত দক্ষতা-অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। যে পরিবেশে বা ওটিতে অপারেশন করা হবে, তার সবকিছু যেন ইনফেকশন কন্ট্রোলে সহায়ক হয়। সবকিছু ঠিক থাকার পরও কিডনি গ্রহীতার শরীরকে রিজেকশন বা বর্জন করতে পারে। কারও কারও প্রতিস্থাপিত কিডনি সচল হতে কিছু সময় লাগে। সার্জারিতে যা জোড়া লাগানো হয়, তা যেন লিকেজ বা ছিদ্র হয়ে না যায়, সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।
কিডনি প্রতিস্থাপিত রোগীর যেহেতু রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তাই তারা সবসময় ইনফেকশন হওয়ার সমূহ ঝুঁকিতে থাকে। এটি আমাদের চিন্তার বড় বিষয়। এ রোগীদের সারাজীবন ইমিউনোসাপ্রেসিভ ড্রাগ গ্রহণ করতে হয়। প্রথম বছর এর সংখ্যা ও ডোজ বেশি থাকে, পরবর্তী বছর থেকে এটি কমানো শুরু হয়। কখনই এ ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করা যাবে না। সাময়িকভাবে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে, যা চিকিৎসাযোগ্য। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের কাছে ফলোআপে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। কোলাহলপূর্ণ জায়গা থেকে গ্রহীতা দূরে থাকবেন; কারণ, এ স্থান থেকে ইনফেকশন ছড়ানোর সুযোগ থাকে এবং তাদের ডিসিপ্লিন লাইফে অভ্যস্ত হতে হবে।
ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল : অধ্যাপক, প্রক্টর ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়