Logo
Logo
×

বাতায়ন

রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও বাস্তবতা

Icon

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও বাস্তবতা

আমাদের দেশের জনগণের কাছে ‘রিমান্ড’ শব্দটি যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। অবশ্য এ ধারণা এক দিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে রিমান্ডসংক্রান্ত বিষয়ে বাস্তবতা অবস্থা দেখতে দেখতে জনগণের মাঝে এ ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে। মূলত ‘রিমান্ড’ শব্দটি ফৌজদারি মামলার জন্য আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। দেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারায় রিমান্ডের কথা বলা হলেও ওই কার্যবিধির কোথাও রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবে রিমান্ড বিষয়ে ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কার্য সমাপ্ত না হলে এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটবর্তী আদালতের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন, যা একসঙ্গে ১৫ দিনের অধিক হবে না। সহজভাবে বলতে গেলে, রিমান্ড হচ্ছে কোনো আমলযোগ্য অপরাধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো আসামিকে পুলিশি হেফাজতে আটক রাখা। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা আটক রাখা যাবে। তারপর আটককৃত বা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হয় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যদি প্রমাণিত হয় আটককৃত ব্যক্তি নির্দোষ, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মুক্তি দেবেন। আর যদি প্রমাণ হয় যে, আটককৃত ব্যক্তি অপরাধী বা তার কাছ থেকে অধিক তথ্য উদ্ঘাটন প্রয়োজন, তাহলে রিমান্ডের সময় বাড়ানো যেতে পারে, তবে তা ১৫ দিনের বেশি হবে না। আর কোনো ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে মারধর করার কোনো বিধান নেই; যদিও আমাদের দেশে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

রিমান্ড বিষয়ে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। রিমান্ড বিষয়ে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনায় কোনো মামলায় আসামি গ্রেফতার এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর দেশে রিমান্ড ইস্যুতে নানা ঘটনার সৃষ্টি হলেও অজ্ঞাত কারণে তা এখন পর্যন্ত সংশোধিত হয়নি। যদিও সংবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশনা প্রতিপালন করা সরকার কিংবা প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য বাধ্যতামূলক। বলা বাহুল্য, দেশে অনেক আগে থেকেই রিমান্ডের বিষয়ে বাস্তবতা ভিন্ন। রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। উচ্চ আদালতে এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছে বহুবার, আদালত থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও রিমান্ডের অপব্যবহার বাড়ছে, যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক। ১৯৯৮ সালে ডিবি অফিসে হেফাজতে মারা যান ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র শামীম রেজা রুবেল। ওই ঘটনা তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বাস্ট) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং ১৬৭ ধারায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করে (রিট পিটিশন নম্বর ৩৮০৬/১৯৯৮)। এ প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ফৌজদারি আইন সংশোধন করতে সরকারকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৫ মে ওই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। রিমান্ড বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের ১৫টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে : ১. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না; ২. কাউকে গ্রেফতার দেখানোর সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে; ৩. গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে; ৪. গ্রেফতারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ; ৫. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে পুলিশকে; ৬. বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যদি কাউকে আটক করা হয়, তাহলে আটক ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে; ৭. আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে; ৮. জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন; ৯. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে; ১০. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে; ১১. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে; ১২. পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে; ১৩. পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয় ওই ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা কি আমাদের দেশে যথাযথভাবে মানা হয় বা মানা হচ্ছে? নিশ্চয়ই না। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তি আদায় করা সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। আর সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন। তাই রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের যে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট সবার যথাযথভাবে মানা উচিত। আর যদি মানা না হয়, তাহলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তবে এ কথা সত্য, অপরাধের ধরন বা প্রকৃতি বা মাত্রা অনুযায়ী অথবা বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে রিমান্ড দরকার হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, অধিকাংশ মামলার ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামির রিমান্ড চায়।

একটি সভ্য সমাজে, একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে রিমান্ড যেন কোনোভাবেই হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত না হয়, তা সংশ্লিষ্টদের সুনিশ্চিত করতে হবে। রিমান্ডের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আর বাস্তব অবস্থার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, যা একটি সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। সুতরাং, বাস্তবতাসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় হাইকোর্ট তথা সুপ্রিমকোর্ট যদি মনে করেন, এভাবে আর রিমান্ডে নিতে দেওয়া যাবে না; তাহলে কেবল সুপ্রিমকোর্টই পারেন এ প্রবণতা রোধ করতে।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

kekbabu@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম