Logo
Logo
×

বাতায়ন

কী ঘটেছে ব্রাজিলে

Icon

থিয়াগো দি আরাগাও ও ওতাভিয়ানো কানুতো

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কী ঘটেছে ব্রাজিলে

গত ৮ জানুয়ারি ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় যে ‘বিপ্লব’ বা ‘উপপ্লব’ ঘটে গেল, তার পেছনে কারণ রয়েছে একাধিক। শুধু একটি কারণকে দায়ী করা যাবে না। ওই উপপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের যেমন ঘটেছিল চিত্তবিভ্রম, তেমনি আবেগ ও অসন্তোষও নেহায়েত কম ছিল না। তদুপরি উত্তেজিত জনতার প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব ছিল প্রকট। নিঃসন্দেহে উপর্যুক্ত কারণগুলো ব্রাসিলিয়ায় যা ঘটে গেছে, তাকে আইনসিদ্ধ করে না; তবে কারণগুলো মনে রাখলে সহজ হবে ঘটনাটি উপলব্ধি করা।

ব্রাজিলের পরাজিত প্রেসিডেন্ট আয়ার বলসোনারোর রোলমডেল ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ট্রাম্প যে কাজটি করেছিলেন, বলসোনারোও দেখালেন একই কাজ। কারচুপির অলীক গল্প বলে সমর্থকদের উত্তেজিত করলেন; পরিস্থিতি এমন দিকে নিয়ে গেলেন যাতে করে ক্ষুব্ধ মানুষ যোগ দেয় বিদ্রোহে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, ২০২০ সালে পুনঃনির্বাচনে হেরে যাওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প খোদ মার্কিন নির্বাচনব্যবস্থার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন; আগামীতে কারচুপি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সমর্থকদের। বলসোনারোও একই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচনের আগেই সমর্থকদের সতর্ক করে বলেন, ২০২২ সালের নির্বাচনে তিনি যদি হেরে যান, বুঝতে হবে জালিয়াতি হয়েছে!

খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে, উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করার আগাম অজুহাত তৈরি করে রেখেছিল। কেবল অজুহাত নয়, সমর্থকদের কিছুটা উসকানিও দিয়ে রেখেছিল, যেন শুধু বিতর্ক সৃষ্টি নয়, হেরে গেলে সত্যি সত্যিই চ্যালেঞ্জ করা যায় নির্বাচনের ফলাফলকে। ফলে ট্রাম্প ও বলসোনারোর দল যখন হেরে গেল, সমর্থকদের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়নি তাদের। রাজনীতিতে অর্ধশিক্ষিত উত্তেজিত সমর্থকরা বিদ্রোহে নেমেছে পরিষ্কার টার্গেট নিয়ে। তবে ট্রাম্পের ঘটনাটি মজার ছিল বেশি। তার সমর্থকরা ভোটের সরকারি ফলাফল চ্যালেঞ্জ করতে সরাসরি মার্কিন সিনেটের যে কার্যালয়ে অনুপ্রবেশ করে, সেখানে প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন ট্রাম্পেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স! ট্রাম্প সমর্থকরা তা জানতেন না হয়তো! বলসোনারো অবশ্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রতি অভিযোগ জানাননি। তার অভিযোগ ছিল নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বিষয়ে। মেশিনগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বিচারপতি আলেহান্ড্রে দি মোরায়েসের নেতৃত্বে সুপিরিয়র ইলেক্টোরাল কোর্ট। এই কোর্টকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বস্তুনিষ্ঠ কোনো অভিযোগ বা প্রমাণ কিছুই ছিল না বলসোনারোর হাতে। ফলে তিনি পুরনো ব্রাজিলিয়ান প্রবাদ ব্যবহার করেন নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর-যদি কাউকে বোঝাতে না পারো, তাহলে সবাইকে বিভ্রান্ত করো। তার দলের অনেকেরই আগে থেকে ক্ষোভ ছিল সুপিরিয়র ইলেকটোরাল কোর্ট, বিশেষত বিচারপতি মোরায়েসের ওপর। নির্বাচনে বলসোনারোর দল একেবারে খারাপ করেছে বলা যাবে না। বরং সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরেছে তারা। শুভবুদ্ধি থাকলে বলসোনারো হয়তো অনুধাবন করতে পারতেন-লড়েই হেরেছেন তিনি। তবে দুর্ভাগ্য বলতে হয়, লুলার বিজয়কে তারা কমিউনিস্ট ক্যু হিসাবে আখ্যায়িত করে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য উপায়ে বিরোধিতা করলেন নির্বাচনি ফলাফলের। লক্ষণীয়, নির্বাচনের পরপর ফলাফল মেনে নিয়েছিলেন বলসোনারো। কিন্তু এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে কোথায় নিজের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করবেন, তা না করে তিনি পুরোটা সময় অপব্যয় করলেন সামাজিক গণমাধ্যমে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত স্বহস্তে প্রস্তুত ভোট জালিয়াতির খবর প্রচারে। অবশ্য নির্বাচনে হারের পর দেশে দেশে অনেক রাজনীতিককে এত বেশি নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায় যে, কিছুটা যেন অবচেতনভাবেই তারা ভাবতে থাকেন-কোনোভাবে যদি ফলটা পাল্টানো যেত! একশ্রেণির রাজনীতি ব্যবসায়ীরা তাই হেরে গেলে পরাজয় মানতে চান না, যেখানে প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক নিজেকে আরও গড়ে তোলার সুযোগ খোঁজেন। যারা স্বচ্ছ নির্বাচনে হেরেও পরাজয় মানতে চান না, তাদের নির্বাচনি রাজনীতির অন্যতম অপকৌশল হচ্ছে, হারের পরপর নতুন গঠিত সরকারের আইনসিদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, যাতে করে নবগঠিত সরকার ক্ষমতা পেলেও আরামের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে না পারে। বলসোনারোও একই কৌশল নিয়েছিলেন। ৮ জানুয়ারির বিদ্রোহে সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস ছিল সত্য। তবে তারও পেছনে যে কারও কারও সবুজ সংকেত ছিল, তা বোঝার জন্য রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার দরকার নেই।

জানি না, ৮ জানুয়ারির ঘটনার পরবর্তী প্রভাব কী হবে। তবে কিছু তাৎক্ষণিক প্রভাব অনুমান করতে পারি। প্রথমত, অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে সহিংসতা দেখিয়ে নিজের পায়ে নিজে গুলি করেছেন বলসোনারো। হতে পারে সরকারি ভবনের ওপর হামলার পেছনে বলসোনারোর সরাসরি কোনো উসকানি ছিল না। কিন্তু ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর ইবানিস রোচা তো তার দলেরই লোক। এখন তো মানুষ প্রশ্ন তুলছে, আগামীতে জনগণের মৌলিক নিরাপত্তা দিতে পারবেন কিনা গভর্নর রোচা! ফলে বিদ্রোহের পরিকল্পনা যিনি বা যারাই করে থাকুক, তাদের চিন্তাভাবনায় পরিপক্বতার ঘাটতি ছিল বলতে হয়। মোদ্দা কথা, যেদিক থেকেই ভাবুন, আরও ক্ষুণ্ন হয়েছে বলসোনারোর ভাবমূর্তি। আগামীতে তিনি যদি কোনো শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভও করেন, সরকার তাদের ওপর কড়া নজরদারি রাখবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বলসোনারোর দলের সমর্থক যোগ্য রাজনীতিকদের যে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ দেওয়ার কথা ছিল, সে সিদ্ধান্ত থেকে সম্ভবত সরে আসবে নতুন সরকার। এরই মধ্যে সরকারি দলের একাধিক ব্যক্তি ইঙ্গিত করেছেন, তারা দেখতে চান বলসোনারো সংসদে এসে প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার বিরোধিতা করতে চান নাকি রাস্তাঘাটে বসে থেকে জনচলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে চান। বলসোনারো সংসদ চান না রাস্তা-এ কৌশলী প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে আরও খারাপ হবে তার ভাবমূর্তি। তিনি তো আর একই সঙ্গে সংসদে ও রাস্তায় থাকতে পারবেন না। তাকে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। ফলে বলসোনারও উচিত এখনই বিদ্রোহীদের কাজের প্রতিবাদ করা। নইলে কংগ্রেসে আরও শক্ত হবে লুলার অবস্থান। ৮ জানুয়ারির ঘটনা প্রতিপক্ষের বহু রাজনীতিককে টেনে নিয়ে এসেছে লুলার কাছে।

লুলার প্রশাসন এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা তদন্ত করে দেখবেন কীভাবে কী ঘটল, কারা পয়সা দিল এবং কারা জোগালো পরিকল্পনা ও ইন্ধন। বিরোধীদলীয় বহু সমর্থককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারপতি মোরায়েসকে এরই মধ্যে বসানো হয়েছে গভর্নর রোচার পদে। তবে আগামীতে প্রতিপক্ষের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট লুলা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসে মুসিও এবং বিচারমন্ত্রী বিচারপতি ফ্লাভিও দিনো দো’র ওপর। আমরা আশা করব, এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন তারা। নইলে ব্রাজিলের রাজনীতি আবার ‘ফ্যাসিস্ট’-‘কমিউনিস্টে’ ভাগ হয়ে যাবে। তদুপরি মাথায় রাখতে হবে, সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নয়; কিন্তু অপরাধমূলক একটি কর্মকাণ্ডেও যেন ছাড় দেওয়া না হয়। আমরা বিশ্বাস করি, ব্রাজিলের গণতন্ত্র এখনো অনিরাপদ নয়। কিন্তু এটি অনিরাপদ হয়ে উঠবে যদি ব্রাজিলের রাজনীতিকরা বিশ্বাস করতে শুরু না করেন যে গণতন্ত্র কোনো পদ্ধতি নয়, গণতন্ত্র একটি মূল্যবোধ।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

লেখকদ্বয় যথাক্রমে আরকো এডভাইস এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম