-67d9e072e4a2e.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার ৮ বছরের কন্যাশিশু আছিয়া হাসপাতালে ভর্তির পর শত চেষ্টা ও দেশের মানুষের আকুল আবেদনের পরও বাঁচানো যায়নি। তার শোকে যখন পুরো দেশ স্তব্ধ, সেদিনই সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ২য় শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। শুধু আছিয়া কিংবা ২য় শ্রেণির শিশু নয়, প্রতিদিনই কোনো না কোনো জায়গায় শোনা যাচ্ছে নারীর আর্তনাদের শব্দ। অথচ দেশব্যাপী চলছে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, চাওয়া হচ্ছে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি। এ আন্দোলন চলাকালেও ধর্ষণে সাজাপ্রাপ্ত অনেক আসামি জামিনে বের হচ্ছে, যা সৃষ্টি করছে বাড়তি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এ মুহূর্তে প্রতি আটজনে একজন নারী ১৮ বছর হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত ৮ বছরে ৩ হাজার ৪৩৮টি ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে আরও বেশি। এর মধ্যে ৫৩৯ জনের বয়স ৫ বছরের কম আর ৯৩৩ জনের বয়স ৬-১২ বছরের মধ্যে। ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক গ্রুপ ইউএনএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ নারী জীবনে কোনো না কোনো সময় শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পুলিশের সদর দপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ধর্ষণের অভিযোগে গড়ে ১২টি করে মামলা দায়ের হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস ছিল ২৯ দিনের, তখনো এ সংখ্যা একই ছিল।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেকে নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও প্রভাব বিস্তারকারী মনোভাব পোষণ করেন। কেউ বা মনে করেন নারী ভোগের বস্তু। অনেক পুরুষ মনে করেন নারীর প্রতি অন্যায় হলে তা কিছুদিন আলোচনার পর সবাই ভুলে যাবে, এ অপরাধের কথা কেউ মনে রাখবে না। ফলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে বৈ কমছে না। তাছাড়া নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসন না মানা, ছোটবেলা থেকে পরিবারে নারী অবহেলার শিকার হওয়া, নারীকে দুর্বল ও তার ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা যাবে, এমন মনোভাবও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে অপসংস্কৃতির চর্চা ও পর্নোগ্রাফিও যৌন নির্যাতনের জন্য অনেকটা দায়ী।
অপরদিকে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বড় অপরাধেও আসামির জামিন পাওয়া, লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে অন্যায়ের কথা প্রকাশ না করা, ক্ষেত্রবিশেষ ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়ের পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখা, দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি না হওয়ার ফলে বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণের হার। সমাজকর্মীদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক তৎপরতার অভাব, ঘুস খেয়ে আসামিকে ছাড় দেওয়ার কারণেও বাড়ছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার হার। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজে ধর্ষণের শিকার বা নির্যাতিত নারীকে তার ওপর ঘটা সহিংসতার জন্য উলটো দায়ী করা হয়। এতে অপরাধী আরও সহজে পার পেয়ে যায়। সমাজে এ অবস্থা থেকে অতিদ্রুত পরিত্রাণ জরুরি। তাই প্রয়োজন আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং অপরাধীকে তার অপরাধের ধরন অনুযায়ী স্বল্প সময়ের মধ্যে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে দেড় লাখের বেশি ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন, গত ২ মাসে যুক্ত হয়েছে আরও মামলা। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। পরিবার থেকে সমাজ-সব পর্যায়ে নারীদের সমান গুরুত্ব ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনও মেনে চলতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নারীর জন্য সব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে না পারে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখা। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ধর্ষণসহ সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী যেন ন্যায়বিচার পায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর নিরাপদ সমাজ উপহার দিতে পারি।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়