বিএনপি-জামায়াত : ঐক্য নাকি বিরোধ?
এ কে এম রেজাউল করিম
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিগত সময়ে দেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা এবং বিভিন্ন দলের নেতাদের ভাষ্যে নতুন এক বাস্তবতা ফুটে উঠছে। জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক এখন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে, যেখানে দ্বন্দ্বের চিহ্ন স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে নতুন এক সমীকরণের সূচনা হতে পারে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রাজনৈতিক মিত্রতার মাঝে ফাটল
২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি ও জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক জোট ভেঙে দেয়। এরপর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে। শেখ হাসিনার সরকার পতনে বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিলেও আসন্ন নির্বাচনে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এ দ্বন্দ্বের মূল কারণ হতে পারে নির্বাচন এবং সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে দল দুটির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন জামায়াত নেতারা।
একাত্তরের ইস্যু ও জামায়াতের ভূমিকা
বিএনপি ও জামায়াতের দ্বন্দ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা। বিএনপির নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই জামায়াতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অভিযোগ তুলে তাদের ভূমিকা সামনে আনছেন। ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা ও তাদের ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনার ঝড় ওঠে, তখন জামায়াত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে চেষ্টা করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জামায়াতের বক্তব্য ও অবস্থান বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে।
সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে আয়োজিত এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর আগে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের ‘পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি’ বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর এই বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এখন একটা সুযোগ এসেছে। এই সুযোগে বোধহয় তারা একাত্তরের ভূমিকার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সেটি না করে তারা একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে জাস্টিফাই করছে।’
বিএনপির এ সমালোচনার পর জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘ডা. শফিকুর রহমান সাহেব তার দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন, কিন্তু তার বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা ঠিক নয়।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘জামায়াত ইসলামী জনগণের কাছে তার ভূমিকা স্পষ্ট করেছে এবং জনগণ অব্যাহতভাবে দলটিকে সমর্থন দিচ্ছে।’
এমন পালটাপালটি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে। বিগত সরকারের পতনের পর জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে একাধিক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, বিশেষত নির্বাচন ও জাতীয় ইস্যুতে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত বরাবরই আলাদা দল ছিল এবং আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানও আলাদা।’ তার মতে, জামায়াতের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে দুটি দলের মধ্যে ‘ন্যাচারালি’ দূরত্ব রয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘এটি কোনো দলের মতামত নয়, বরং নেতার ব্যক্তিগত মতামত।’ তার মতে, এমন বক্তব্য দুটি দলের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে।’
এটি স্পষ্ট যে, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণ শুধু আদর্শগত নয়, বরং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। জামায়াতের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা এবং বিএনপির সে বিষয়ে মতপ্রকাশ রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আগামী দিনে দুই দলের সম্পর্ক আরও জটিল হতে পারে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।
নির্বাচনি রোডম্যাপ : জামায়াতের সংশয়
নির্বাচনি পরিকল্পনা নিয়েও বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একে অপরের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপি আগ্রহী দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে, কিন্তু জামায়াতের অবস্থান ছিল, মৌলিক সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। জামায়াত চায়, সব রাজনৈতিক দল একত্রে আসবে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংস্কার করা হবে।
এছাড়া নির্বাচনি পদ্ধতি নিয়েও দুই দলের মধ্যে বিরোধ লক্ষ করা গেছে। বিএনপি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও জামায়াত এটির পক্ষপাতী। একইভাবে বিএনপি ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও জামায়াত তা সমর্থন করছে। এ মতবিরোধ ভবিষ্যতে আরও তীব্র হতে পারে, যা দুই দলের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে।
জামায়াতের নীরব শক্তি
বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বিরোধ সত্ত্বেও জামায়াতের নেতারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের দলের ভূমিকা সামনে আনা সহজ হবে না। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘বিএনপি যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষের বিভক্তি নিয়ে সামনে চলে আসে, তবে জনগণ তা ভালোভাবে নেবে না।’ এটি দল দুটির মধ্যে বিদ্যমান গভীর রাজনৈতিক বিরোধের একটি প্রমাণ।
এ মুহূর্তে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলের জন্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জনগণের সমর্থন অর্জন জরুরি। বিশেষত, জামায়াতের শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তারা রাজনৈতিক দিক থেকে নতুন কৌশল গ্রহণ করতে পারে, যা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পর্যালোচনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে বর্তমান দ্বন্দ্ব শুধু দলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের ফল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে আরও গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত বহন করছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগেই যদি দল দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়, তাহলে এটি একটি বড় রাজনৈতিক অশান্তির কারণ হতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, জামায়াত যদি নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থান নিয়ে অংশগ্রহণ করে, তাহলে তা নির্বাচনে তাদের সম্ভাব্য আসন সংখ্যা ও রাজনৈতিক শক্তির ওপর কী প্রভাব ফেলবে? জামায়াতের উপস্থিতি বিএনপির জন্য লাভজনক হবে, নাকি তা একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টতই একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করতে পারে। নির্বাচনের আগে তাদের সম্পর্কের প্রকৃতি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম : কলামিস্ট, সমাজসেবক ও রাজনীতিক