
প্রিন্ট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১৩ এএম

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার। ছবি:সংগৃহীত
আরও পড়ুন
নিউইয়র্ক সিটির পাঁচটি বরোর মধ্যে কুইন্স বরোর জ্যামাইকা অন্যতম মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। সিটির অন্যতম বৃহৎ দুটি মসজিদ বাংলাদেশি-আমেরিকানদের দ্বারা পরিচালিত ‘জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার’ (জেএমসি) এবং পাকিস্তানি-আমেরিকানদের দ্বারা পরিচালিত ‘ইকনা’ (ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা) মসজিদ জ্যামাইকায় অবস্থিত। আমার বাসস্থান থেকে হাঁটাপথে ২ মিনিটের দূরত্বে একটি ছোট মসজিদ আছে। কিন্তু আমি প্রায়ই শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে ২৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত ‘ইকনা’ মসজিদে যাই। সেখানে প্রচুর মুসল্লির সমাবেশ ঘটে এবং একসঙ্গে চেনাজানা অনেকের সাক্ষাৎ মেলে। পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত হলেও মসজিদটি বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত বলে মুসল্লিদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। অনেক চেনামুখ, দেখতে দেখতে মুখগুলো পরিচিত হয়ে গেছে। প্রবাসজীবনে একসঙ্গে অনেক চেনামুখের দেখা পাওয়াও বিরাট সান্ত্বনার ব্যাপার। আমার সঙ্গে কথা বলা বা সালাম বিনিময়ের সম্পর্ক আছে গুটিকয়েক মুসল্লির সঙ্গে।
সম্প্রতি এক শুক্রবার ইকনা মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়ে মনে মনে একটি হিসাব কষে দেখার ইচ্ছা হলো, কোন্ বয়সি লোকজন নামাজ পড়তে আসেন! মসজিদটির ধারণক্ষমতা কম নয়। প্রথম জামাতে বেজমেন্ট, প্রথমতলা ও দ্বিতীয়তলায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় এক হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। দ্বিতীয় জামাতে মুসল্লির সংখ্যা কিছু কম থাকে। দরজার কাছাকাছি একেবারে শেষ কাতারে বসায় মুসল্লিদের প্রবেশের সময় চেহারা দেখতে সুবিধা হয়েছিল। দৃশ্যত, ৮০ শতাংশ মুসল্লির বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। কয়েকজনের বয়স একটু বেশি হতে পারে। ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সের মধ্যে হবে ১৫ শতাংশের। বাদবাকির বয়স ৪০ বছরের নিচে। কিন্তু বিশোর্ধ্ব বয়সি তরুণ মুসল্লির সংখ্যা হাতে গোনা যায়।
এ দৃশ্য সম্ভবত সব ধর্মের প্রার্থনাস্থলের। মানুষের বয়স যত বাড়ে, ধর্মকর্মে তাদের মনোযোগ তত বৃদ্ধি পায়। কম বয়সিরা সম্ভবত মনে করে, তাদের কোনো একটি ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই বড় কথা। এর কারণ বের করতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। সব ধর্মবিশ্বাসী তরুণ হয়তো মনে করে, জীবন তো একটাই; আর তরুণ বয়সেই যদি এ নশ্বর জীবনকে উপভোগ করা না যায়, তাহলে জীবনের আর মর্ম কী থাকে! দুনিয়ায় গবেষণার বিষয়ের অন্ত নেই। বৃদ্ধদের ধর্মে মতি ফেরা নিয়েও গবেষণা রয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোনো বিষয় নেই, যার ওপর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করা হয় না অথবা জরিপ বা সমীক্ষা চালানো হয় না। মুসলমানদের সব গৌরব যেহেতু অতীতের, অতএব তারা এসব নিয়ে গবেষণার ধার ধারে না।
তাছাড়া বহু মুসলমানের প্রচলিত ধারণা হলো, পাপকর্ম যত শাস্তিযোগ্য হোক না কেন, ‘তওবা’ করলে ‘মহাপাপ’ পর্যন্ত মার্জনাযোগ্য। অতএব অনেক মুসলমান হরহামেশা ছোটখাটো পাপ করাকে ঐশীভাবে শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচনা করে না। কারণ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কেউ হয়তো তাদের তালিম দিয়েছেন, মহান সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, যার ৯৯টি নামের মধ্যে দু-একটি ছাড়া সবগুলোর মর্মার্থ তার সৃষ্ট আশরাফুল মখলুকাত অর্থাৎ মানুষের অনুকূলে, অতএব ‘তওবা’য় ছাড় পাওয়া যাবে। বোখারি ও মুসলিম শরিফে লিপিবদ্ধ হাদিস অনুসারে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নামগুলো সম্পর্কে জানবে, বুঝবে এবং উপলব্ধি করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ ‘তওবা’য় মার্জনা লাভ এবং জান্নাতে প্রবেশের এত সহজ উপায় থাকলে পাপকর্ম বন্ধ হওয়ার তেমন সম্ভাবনা থাকে না। ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি’-এ প্রবাদই সদর্পে প্রতিষ্ঠিত। তাই পাপাচার বন্ধ হয় না।
যা হোক, আমেরিকার পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ আমেরিকান খ্রিষ্টানের ব্যক্তিগত ঈশ্বর আছেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে যিশুখ্রিষ্টকে শ্রদ্ধা করেন এবং প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর ‘ক্রিসমাস’ উদ্যাপন করেন। ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, সেসব আমেরিকান খ্রিষ্টানের ৪৮ শতাংশ নিয়মিত চার্চে যান। তবে আমেরিকানদের ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে ২৭ শতাংশ চার্চে গমন করেন। ৮০ শতাংশ আমেরিকান ভাবেন, ধর্ম তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও তাদের সবাই ধর্মচর্চা করেন না। অনেক আমেরিকান রয়েছেন, যারা নিজেদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা ছাড়া আর কখনো চার্চে যাননি। বৃদ্ধদের ধর্মানুরাগী হওয়ার কারণ হিসাবে কিছু মনস্তত্ত্ববিদ মনে করেন, বৃদ্ধরা নিজেদের নশ্বরত্ব নিয়ে সহসা ভীত হয়ে ওঠেন, ধর্ম বৃদ্ধদের সেই ভীতি প্রশমনে সহায়তা করে।
ধর্মীয় বিশ্বাসের বিচারে আমেরিকায় ইহুদিরা দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। ইহুদিদের কট্টর ধার্মিক হিসাবে বিবেচনা করেন অনেকে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ আমেরিকান ইহুদির ধর্ম তাদের জীবনের মুখ্য বিষয় নয়। তিন-চতুর্থাংশ আমেরিকান ইহুদির কাছে তাদের ইহুদি পরিচয়ই মুখ্য। এমনকি বয়স্ক ইহুদিরা বয়স্ক খ্রিষ্টানদের চেয়ে ধর্মকে তাদের জীবনে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আমেরিকান ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ‘জায়নিজম’ বা ‘ইহুদিবাদের’ ধারক, যাকে এক অর্থে উগ্র ‘বর্ণবাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এমনকি ইসরাইল রাষ্ট্রকে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় রাষ্ট্র না বলে পাশ্চাত্যের অনেক দেশেও বর্ণবাদী ইহুদি রাষ্ট্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের দুজন গবেষক ডেভিড হেওয়ার্ড ও নিল ক্রাউস তাদের দীর্ঘ সময়ের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন এক দশক আগে। তারা বিশ্বের ৮০টি দেশের ১২ বছর বয়সি থেকে ১০৪ বছর বয়সি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ৭,২৬,৯৭৭ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, সর্বত্র সব ধর্মে বৃদ্ধরা অধিক ধর্মানুরাগী। তবে তারা এটাও লক্ষ করেছেন যে, পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশ ও ল্যাটিন আমেরিকার খ্রিষ্টবাদে বিশ্বাসী, চীনের কনফুসিয়ান মতবাদে বিশ্বাসী বৃদ্ধরা অধিক হারে ধর্মচর্চা করেন। সে তুলনায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো এবং মুসলিম দেশগুলোতে মধ্যবয়সি ও বৃদ্ধ ধর্মানুরাগীর সংখ্যা প্রায় সমান। আফ্রিকার দেশগুলোতে যে কোনো ধর্মবিশ্বাসী তরুণদের মধ্যে প্রার্থনাস্থলে গমনের হার বেশি।
বিশ্বজুড়ে পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়ায় বয়স্ক লোকজন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তারা ক্রমবর্ধমান হারে পরিচিতির সংকটে পড়েন। শেষ জীবনে মানুষের মৃত্যুভীতি বৃদ্ধি পায় এবং তারা মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে ধর্মের আশ্রয় নেন। যৌবনে তারা ধর্মের প্রতি কোনো দুর্বলতা না দেখালেও বার্ধক্য তাদের যৌবনের অহঙ্কার গুঁড়িয়ে দেয়। তবে গবেষকরা দেখেছেন, দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অধিকাংশ মানুষ যেহেতু ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেহেতু তারা শৈশব থেকেই ধর্মচর্চার মধ্যে থাকে, যা বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে বা শুধু উত্তর আমেরিকায় নয়; বিশ্বের বহু দেশ বা অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান হারে তরুণ মুসলিমের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকর্ষণ, অনুরাগ, জ্ঞান-গবেষণা, নামাজমুখী ও মসজিদমুখী প্রবণতা, মসজিদভিত্তিক দাওয়াহ্ ও বয়ান, ইসলামি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা, আইটি বেইজড চর্চা ও গবেষণা, অধিক হারে হজে গমন, তরুণীদের হিজাবের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে। সর্বোপরি আমেরিকায় তরুণ সমাজের কাছে ইসলামি ভাবাদর্শ ও ধর্মচর্চা ক্রমাগত আবেগের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ইতোমধ্যে বিশেষ করে তরুণ মুসলিমদের অব্যাহত প্রয়াসের সাফল্যে নিউইয়র্কের মসজিদগুলো থেকে মাইকে আজান দেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসনের বহুল কাঙ্ক্ষিত অনুমোদন, দুই ঈদে নিউইয়র্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসে যথাক্রমে মুসলিম শিক্ষার্থী ও শ্রমিক-কর্মচারীদের ছুটি কার্যকর হওয়ার মতো বিষয়গুলো তরুণ মুসলমানদের ধর্মচর্চায় মনোযোগী হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে। ওই সূচকগুলো যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ মুসলমানদের বিকাশমান অবস্থার পরিবর্তিত চালচিত্র তুলে ধরছে। আমেরিকা থেকে প্রতিবছর যারা পবিত্র হজ পালন করতে যান, তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। অথচ আমরা দেশে অবস্থানকালে বয়োবৃদ্ধদেরই হজে যেতে প্রত্যক্ষ করেছি। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে বৃদ্ধরাই মূলত হজ পালন করতে যান। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দেশে থাকতে ধর্মে যাদের তেমন মতিগতি ছিল না, তাদের বড় অংশই আমেরিকায় এসে ধর্মকর্মে মনোযোগী হন। যারা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ মন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তারাই মসজিদ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন, আমেরিকান শিক্ষার বাইরে উইকএন্ডসে সন্তানদের মসজিদগুলোর ইসলামিক সেন্টারে পাঠান। এমনকি অনেকে সন্তানদের কুরআনে হাফেজ হিসাবে তৈরি করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় বিশ্বাস ও জাতিগত পরিচয়ে জনগণনা করা হয় না। সেজন্য কোন্ ধর্মাবলম্বী বা জাতিভিত্তিক জনসংখ্যা কত, তা সঠিকভাবে জানার সুযোগ নেই। সাধারণভাবে বলা হয়, বা দৃশ্যমান, আমেরিকায় খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসীর সংখ্যা সর্বাধিক। এর পরের স্থান ইহুদিদের, তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এবং হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যা যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, সব ধর্মের তুলনায় আমেরিকায় অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্য থেকে ইসলামে দীক্ষিতের সংখ্যা অধিক। সেজন্য কট্টরপন্থি খ্রিষ্টানরা আমেরিকায় মুসলিম জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হারকে মেনে নিতে পারে না। তারা ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় লিপ্ত হয়। নিউইয়র্কের মতো বড় সিটিতে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখ, মসজিদের সংখ্যা ২৭৫টির বেশি, সেখানে মুসলিম বিদ্বেষ দৃশ্যমান। তবে সিটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা ধর্ম ও জাতিগত বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কঠোর থাকায় এ ধরনের বিদ্বেষের প্রকাশ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে না।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক