
প্রিন্ট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৫২ এএম
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আলোর রেখা দেখালেন ড. ইউনূস

আরও পড়ুন
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ যখন অনেকটা দিশেহারা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় আশ্রিত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার খাদ্য, চিকিৎসা এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ নিয়ে সবাই চিন্তিত; ঠিক সে সময়ে থাইল্যান্ডে বিমসটেকের সাইডলাইন মিটিংয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
প্রফেসর ইউনূসের কোন জাদুর বলে মিয়ানমার সরকার দীর্ঘ ৮ বছর পর এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা একসঙ্গে ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রফেসর ইউনূসের অবিরাম কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে আগমন এবং ড. ইউনূসের অনুরোধে ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করে এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান এবং চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূস সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া-সবকিছু মিলে সামগ্রিকভাবে অচলাবস্থায় থাকা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কিছুটা আলো দেখা যাচ্ছে।
গত ১৫ মার্চ এক টিভি টকশোতে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা আগামী ঈদ আপনাদের দেশে করবেন,’-এ বক্তব্য কতটুকু বাস্তবসম্মত বলে আপনি মনে করেন? উত্তরে বলেছিলাম, ‘জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সামনে প্রফেসর ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিত্ব শুধু লিপ সার্ভিস দেওয়ার জন্য এ কথা বলবেন, তা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ বিস্ময়ের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষ এত দ্রুত এ সুখবরটি পাবেন, হয়তো তা ধারণাও করেননি। এটাকে ইউনূস-কারিশমা বললেও অত্যুক্তি হবে না।
কথিত আছে, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তার সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সংকট ও সংস্কারের বিষয় থাকা সত্ত্বেও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে জাতির ওপর থেকে এত বিশাল বোঝা কমানোর প্রক্রিয়া প্রফেসর ইউনূস কীভাবে এত দ্রুত সময়ে করলেন, তা সত্যিই কৌতূহলের বিষয়। সংগত কারণেই প্রশ্ন, হাসিনা সরকার দীর্ঘ সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও পাঠাতে পারল না, সেখানে কেন মিয়ানমার সরকার প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে ফেরত নিতে এখন রাজি হলো?
কিছু কারণ মিয়ানমারের এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা করা যায়-
১. প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করে আসছেন। গত মাসে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে যৌথভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তারা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং আগামী রোজার ঈদের আগেই রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেন। দুই নেতা এ প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রত্যাবর্তনের পর শরণার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা করেন।
২. জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনার পর প্রফেসর ইউনূস বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সফরের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য চীনের প্রভাব ব্যবহার করা। আলোচনায় বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি থাকলেও এতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা হয়। এ আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের সমর্থন আহ্বান করা হয়। বঙ্গোপসাগরে চীনের নেভাল এবং কৌশলগত স্বার্থ এবং মিয়ানমারের ওপর তাদের প্রভাব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা যেতে পারে। মিয়ানমারের ওপর চীনের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন সহজতর করার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
৩. বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, যেটিকে আঞ্চলিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ হিসাবে দেখা দিতে পারে। এ অবস্থান থেকে মিয়ানমার সরে এসে যদি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেয়, তবে এটিকে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ হ্রাস এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের একটি পদক্ষেপ হিসাবে দেখা যেতে পারে। মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। বহু বছর ধরে চলা সংঘাতের কারণে ওই অঞ্চলটি উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
৪. প্রফেসর ইউনূস বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট কেবল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমস্যা নয়, বরং এটি একটি আঞ্চলিক সমস্যা। তিনি আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন) এবং অন্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে এ সংকট মোকাবিলায় আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি চীন সফরের সময় বোআও ফোরাম ফর এশিয়ায় তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এশীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রফেসর ইউনূস মিয়ানমার এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তার মর্যাদাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। তার এ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের আশার আলো বলা যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক বড় সাফল্য হবে। তবে এ প্রক্রিয়া এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রোহিঙ্গাদের অধিকার, তাদের নিরাপত্তা এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নগুলো এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করবে মিয়ানমারের সদিচ্ছার ওপর।
১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা কবে ফেরত যাবে, তা আগামীতে জানা যাবে। আমি ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে গবেষণার কাজে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বৃদ্ধ থেকে যুবক, সব রোহিঙ্গাই তাদের মাতৃভূমিতে নির্ভয়ে প্রত্যাবর্তন করতে চায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা জাতিসংঘের গ্যারান্টি চায়। অতীতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে ফেরত গেলেও রাখাইনে তাদের অধিকার হরণ, এথনিক ক্লিনজিং এবং মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবর্তন চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় রোহিঙ্গারা বারবার বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তাই একটি ‘টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের’ জন্য জাতিসংঘ এবং চীনের তৃতীয় পক্ষ হিসাবে গ্যারান্টর থাকা জরুরি। আফ্রিকার শরণার্থীদের নিজভূমিতে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের UNHCR-এর গ্যারান্টর হওয়ার নজির রয়েছে। প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কাজ করছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা এসব বিষয়ে অবগত আছেন এবং বিবেচনা করছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আরও কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আরাকানের প্রায় ৯০ শতাংশ এখন আরাকান আর্মির দখলে। এ অবস্থায় জান্তা সরকার কীভাবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে? এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির সমঝোতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান আর্মি একটি নন-স্টেট এনটিটি হওয়া সত্ত্বেও Track II লেভেলে বাংলাদেশ সরকার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে আমেরিকা ও চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তাদের প্রভাবের কারণে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ‘রোহিঙ্গাদের ইউনাইটেড ভয়েস’কে আমলে নিতে হবে। যে কোনো আলোচনায় তাদের ক্যাম্প-বেইজড বৈধ প্রতিনিধিত্ব থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। তারা ভিকটিম, তাই তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি অবজ্ঞা করলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। রোহিঙ্গাদেরও ইউনূস সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য সরকারকে সব রকম সহযোগিতা করা উচিত। আমাদের প্রত্যাশা, রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে আত্মমর্যাদার সঙ্গে ফিরে গিয়ে সব অধিকার নিয়ে বসবাস করবে এবং এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বৃহৎ শক্তিগুলো ভূরাজনীতির চেয়ে মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে।
প্রফেসর ড. এম জসিম উদ্দিন : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক; পরিচালক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি