
প্রিন্ট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৫ এএম
জনপ্রশাসনে গতি ফিরবে কবে

মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, সে সরকারের জনপ্রশাসনের চলার গতি হওয়া উচিত ছিল জেট বিমানের। কিন্তু বাস্তবে অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রশাসনের চলার গতি জেট বিমানের তো নয়ই, এমনকি রেলগাড়ির গতিতেও নেই। জনপ্রশাসন চলছে ধীরগতিতে। এ গতিও মাঝে-মধ্যেই খানাখন্দ ও কাদায় পড়ে থমকে যাচ্ছে। বর্তমান জনপ্রশাসন সাধারণ রুটিন দায়িত্বও ঠিকমতো পালন করতে সক্ষম হচ্ছে না। যার কারণে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি বিঘ্নিত হচ্ছে; অহরহ জনশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। ক্রমেই চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সাধারণ সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও ভোগান্তির শিকার এখন জনগণ। এতে জনমনে অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে, যার পরিণতি মোটেই মঙ্গলজনক নয়।
বিগত সরকারের অতিমাত্রায় দলীয়করণ এবং জনপ্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতির লাগামহীন বিস্তারের কারণে জনপ্রশাসন পরিণত হয়েছিল একটি অকার্যকর জনপ্রশাসনে। এ অকার্যকর জনপ্রশাসন ছাত্র-জনতার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে তছনছ হয়ে একটি ভঙ্গুর ও অস্থির জনপ্রশাসনে পরিণত হয়েছিল। জন-আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজই হওয়া উচিত ছিল সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ভঙ্গুর ও অস্থির জনপ্রশাসন সুসংগঠিত করে বিরাজমান অস্থিরতা দূর করে জনস্বার্থে জনপ্রশাসনকে কাজে লাগানো। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়েছে? মনে হয় না। জনপ্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য যে রকম দূরদর্শিতা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল, তাতে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল বলেই মনে হয়। প্রয়োজন ছিল দূরদর্শিতা ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে জনপ্রশাসনকে সাজানোর। প্রয়োজন ছিল ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে বেরিয়ে এসে শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং ক্রাইসিস মোকাবিলায় পারদর্শী ও নেতৃত্বদানের গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের পদায়ন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোয় পদায়নে ব্যক্তিগত পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরিণতি ভোগ করছে এখন সমগ্র জনপ্রশাসন। জনপ্রশাসনকে সুসংগঠিত করার মতো যোগ্যতা ও দক্ষতা তারা দেখাতে পারেননি। তাদের অনেকের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলিরও অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া তাদের ক্রাইসিস মোকাবিলায়ও পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে না। উপরন্তু অস্থির জনপ্রশাসনে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ। এ অস্থিরতা যে সহজে দূর হবে না, তা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এছাড়া ব্যাপকহারে বাধ্যতামূলক অবসর এবং ওএসডি করার কারণে এ অস্থিরতার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশাসনিক ব্যাপক শূন্যতা, যা দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে একটা নাজুক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সাধারণত কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার হিসাবে সব সরকারই চৌকশ, দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন কর্মকর্তাদের বাছাই করে থাকে। বিগত সরকারের আমলের তিনটি নির্বাচনে যেসব জেলা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যেসব পুলিশ সুপার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্যে অনেককেই গণহারে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হচ্ছে বা ওএসডি করা হচ্ছে। বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা পূর্ণ অবসর সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। তাছাড়া এ ধরনের অবসর অতীতে আইনের লড়াইয়ে টিকেনি। এবারও টিকবে বলে মনে হয় না। সরকার বা অবস্থার পরিবর্তন হলে এরা আবার ফিরে এসে উচ্চতর পদগুলোতে আসীন হতেও পারেন। যেমন হয়েছে বিগত সরকারের আমলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে।
বাধ্যতামূলক অবসর এবং ওএসডি দ্বারা জনগণের কোনো উপকার হয় না। সরকারের কাছে যদি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর অপরাধের তথ্য-প্রমাণ থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা আনয়ন করে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে বিধিসম্মতভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলে তো অবসর ভাতাদি দিতে হতো না, জনগণের টাকার সাশ্রয় হতো। কিন্তু তা না করে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হচ্ছে। এরূপ বাধ্যতামূলক অবসরকে জনগণও ভালোভাবে নেয় না। জনগণ একে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ বলেই মনে করে। এছাড়া এর ফলে যে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, তা পূরণের সঠিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও মনে হয় না।
ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি এবং নিয়মিত পদোন্নতি, উভয় ক্ষেত্রেই বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আশ্রয়ে বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে মনগড়া অজুহাতে বঞ্চনার প্রশ্ন উঠছে। অতীতে যারা বঞ্চনার শিকার ছিলেন, বঞ্চনার অবসান শেষে গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদগুলোতে আসীন হয়ে বঞ্চনার যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে তাদের অনেকে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে আবার বঞ্চনার শিকারি সাজলেন! এক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে বঞ্চনার নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি একবারও ভাবা হয়েছে বলে মনে হয়নি।
অস্থির জনপ্রশাসন আরও অস্থির হওয়ার কারণে এর প্রভাব পড়ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। এতে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। জনগণের সাধারণ সেবাপ্রাপ্তিতে দেখা দিচ্ছে ভোগান্তি ও বিড়ম্বনা। মব জাস্টিসের কারণে নিরীহ লোকজন হেনস্তার শিকার হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে। ভঙ্গুর ও অস্থির জনপ্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবেই এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রশাসনের কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজ জনস্বার্থের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও তা যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের বা গোষ্ঠীর মনঃপূত না হয় বা তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের অনুকূলে না যায়, তাহলে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নেমে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে যাচাই না করেই সরকারও তাতে সায় দিচ্ছে। এতে করে প্রশাসন আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। মনে রাখতে হবে, এ জনপ্রশাসনই বিগত পনের-ষোল বছর ফ্যাসিবাদী সরকারের অধীনে কাজ করেছে। সুতরাং জনপ্রশাসনের প্রায় সবাইকে ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর হিসাবে অপবাদ দেওয়া খুবই সহজ এবং এ সুযোগটাই অনেকে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, যে সিদ্ধান্ত ও কাজ নিয়ে কোনো গোষ্ঠী আন্দোলনে নামছে, সে সিদ্ধান্ত ও কাজটি জনস্বার্থের অনুকূল কিনা। যদি সিদ্ধান্ত বা কাজটি জনস্বার্থের অনুকূলে না হয়ে থাকে, তাহলে ওই আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করা উচিত। কিন্তু যদি দেখা যায়, সিদ্ধান্ত বা কাজটি জনস্বার্থবিরোধী এবং অন্য কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে, তাহলে তার দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ করে বিধিসম্মতভাবে তাকে শাস্তি দেওয়া।
বর্তমান জনপ্রশাসনের অনেকেই গোপনে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে দ্বৈত নাগরিকদেরও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলেও সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, যা কোনোভাবেই জনস্বার্থে কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, যে ব্যক্তি নিজের এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশ্যে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থের চেয়ে তার নিজস্ব স্বার্থ এবং যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, সে দেশের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পাবে, এটাই স্বাভাবিক। স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সেই ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন না। এছাড়া এদের অধিকাংশেরই বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতি করে সময় বুঝে দেশত্যাগ করার প্রবণতা থাকবে। সুতরাং জনস্বার্থেই সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ