
প্রিন্ট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৪৭ পিএম

সৌমিত্র দস্তিদার
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
বেড়াল মাছ খাবে না বললে তবুও যদি বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু ভারতের শাসক বিজেপির সংখ্যালঘু দরদি চেহারা কোনো শিশুও মানা দূরে থাক, কল্পনাও করতে পারবে না। বিজেপির জন্ম তো প্রায় এই সেদিন। তার আদি সংস্করণ জনসংঘের দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটলেই স্পষ্ট-দল হিসাবে সে কতটা উগ্র সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। জনসংঘ থেকে বিজেপির রূপান্তর হয়েছে; কিন্তু তাতে দলের ভাবনা-চিন্তার কিছুমাত্র বদল ঘটেছে, তা তার অতি বড় বন্ধুও বলবে না। বিজেপির কিছু করার নেই। তাদের আসল চালিকাশক্তি আরএসএসের এজেন্ডাই হচ্ছে ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ১৯২৫ সালে নাগপুরে জন্ম নেওয়া আরএসএস একশ বছরে পা রাখছে এ বছরেই। ফলে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের নখদন্তহীন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি বিজেপি-আরএসএসের পরিকল্পিত নীতি। ফলে রাতের অন্ধকারে পার্লামেন্টে তড়িঘড়ি ওয়াকফ বিলকে আইনে পরিণত করার তৎপরতা আসলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সবক শেখানো, ‘আমাদের কথামতো না চললে ভবিষ্যতে অনেক দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।’ আরএসএস ইতোমধ্যেই নতুন করে কট্টর লাইনের দিকে ঝুঁকে মন্দির ইস্যুকে সামনে আনছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা সময়ে যেমন আওয়াজ উঠেছিল-ইয়ে তো স্রিফ ঝাঁকি হ্যায়, মথুরা, কাশি বাকি হ্যায়; এখন আবার সেই মন্দির-মসজিদ বিতর্ক টেনে এনে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে বিজেপি ও সংঘ পরিবার। গত লোকসভা নির্বাচন ও অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যের, বিশেষ করে দিল্লি বিধানসভা জিতলেও বিজেপির শাসকদের নিরুদ্বিগ্ন থাকার পরিস্থিতি নেই। একে তো খোদ লোকসভাতেই বিরোধী দলের আসন সংখ্যা খুব কম নয়; যখনই কোনো আলোচনা শুরু হয়, আগের চেয়ে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ চেহারার পাশে শাসকদের কখনো কখনো বেশ ম্লান লাগে। তাছাড়া ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও যত বলা হয়, তত শক্তিশালী নয়।
দেশের বিদেশনীতি নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত কতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, তা নিয়ে কংগ্রেসের প্রভাবশালী এমপি শশী থারুর অবধি প্রশ্ন তুলেছেন। চীন কাঁটা তো ভারতকে সবসময় চাপে রাখে। এ পরিস্থিতিতে চাপমুক্ত হতে ধর্মীয় বিভাজনের রাস্তা বেছে নিচ্ছে আমাদের শাসক দল। ঠিক সে কারণেই কখনো নাগপুরে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের চারশ বছরের পুরোনো কবর ভাঙার চেষ্টা চলছে, কখনো আবার ইতিহাস থেকে মোগল আমলের স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে সংঘ ব্রিগেড। পশ্চিমবঙ্গে তো আসন্ন রামনবমীর দিন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলছেন বিজেপির নেতারা। ওয়াকফ আইনের সংস্কারের উদ্দেশ্যে গত আগস্টে বিলটি লোকসভায় পেশ করে শাসক শিবির। ওয়াকফ বিলটির পুরো নাম বিশালু ইউনিফায়েড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট এমপাওয়ারমেন্ট এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট; সংক্ষেপে উম্মিদ বা আশা। সংসদে বিলটি পেশ করেন সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী কিরণ জিজেজু।
সাধারণভাবে বিজেপি গত কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘু, মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এমন মায়াকান্না কাঁদে, যাতে তথাকথিত অনেক প্রগতিশীল লোকজন পর্যন্ত ভাবতে বসেন, বিজেপি বোধহয় সত্যিই সবকা সাথ সবকা বিকাশের পথে হাঁটতে চাইছে। কাশ্মীরের বিতর্কিত ৩৭০ ধারা বিলোপের সময় সে আগামী উন্নয়নের এমন ফিরিস্তি দিল, যাতে মনে হয়েছিল, কাশ্মীর সত্যি সত্যি স্বর্গ হয়ে উঠতে চলেছে। ৩৭০ নিয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে এমন প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল যে, এক দেশে ভিন্ন আইন থাকবে কেন! কেন একই দেশের অপর প্রদেশের লোক কাশ্মীরের জমি কিনতে পারবে না! কথায় বলে, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। ৩৭০ উঠে গেছে। কিন্তু হিমাচল প্রদেশ ও অন্য অনেক রাজ্যে স্থানীয় লোকজন ছাড়া কেউই আজও জমি কিনতে পারেন না। ৩৭০ গেছে। ৩৭১ থেকে গেছে। ইউনিফায়েড সিভিল কোডের ক্ষেত্রেও তাই। এক দেশে ভিন্ন ভিন্ন আইন কেন থাকবে! ভাবটা এমন, সংখ্যালঘু মুসলমান যেন শরিয়তি আইন মেনে চলতে চায়। আসলে আমাদের দেশের ক্রিমিনাল ল’ সবার জন্য এক। ফৌজদারি আলাদা আলাদা। ধরুন, হিন্দুদের বিয়ে আর খ্রিষ্টান, মুসলমানদের বিয়ের নিয়মকানুন আলাদা। আসলে বিজেপি বিপুল প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গোটা দেশের মধ্যেই বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো আর শাসন করো’র নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার দক্ষতা বিজেপির মতো আর কোনো দলের নেই। পার্লামেন্টে ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনার সময় শিখ সংসদ সদস্য হাসমিত কাউর যুক্তিতর্কে নাস্তানাবুদ করতে করতে শাসক শিবিরের দিকে আঙুল তুলে বলছিলেন-‘আপনারাই টুকরে টুকরে গ্যাং। ভারতকে ভেঙে দিতে চাইছেন। তিনি আরও বলছিলেন, এখন আপনারা ওয়াকফ সম্পত্তির নামে মুসলিম জমি লুট করতে চাইছেন। এরপর শিখ, খ্রিষ্টান, কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আপনাদের লোভের হাত থেকে নিস্তার পাবে না।’
বলা হচ্ছে, ভারতে রেল, ডিফেন্সের পর সবচেয়ে বেশি জমি আছে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে। রাজেন্দ্র সাচার কমিটি জানিয়েছিল, ওয়াকফ সম্পত্তির সামান্য অংশ কাজে লাগালেও দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নতি হতো। এটি ঠিকই, ওয়াকফ সম্পত্তির দায়িত্ব যাদের হাতে-মুসলিম নেতৃত্বের তরফেও গাফিলতি নিশ্চিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে রাজ্যের শাসক দলের লোকজন। বিজেপি শাসকরা চাঁদ সওদাগরের লৌহ বাসরের ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢোকার কৌশলেই মুসলিম নেতাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আগামী দিনে মুসলিম জমি দখলের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে তৎপর। ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কবর, মাজার, ঈদগাহ, মসজিদ সব ওয়াকফ সম্পত্তি। তা কখনোই কোনো ব্যক্তির নয়। এ সম্পত্তির সব ধরনের কার্যকলাপ, বিবাদ, অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্ব মুসলিম ওয়াকফ বোর্ডের। এখন কেন্দ্রীয় সরকার নানা কৌশলে সেই অধিকার কেড়ে নিয়ে নিজেরা জমির মালিকানা নিতে উদ্যোগী বলেই ঝড় উঠেছে। কেন্দ্রের যুক্তি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যাতে কোনো বৈষম্য ও দুর্নীতির শিকার না হয়, সেই কারণেই সরকার নাক গলাতে বাধ্য হচ্ছে। এখানেই সন্দেহ হয় বলেই বলেছি, বিজেপির সংখ্যালঘু দরদ যথেষ্ট সন্দেহজনক। যে সংসদে ওয়াকফ বিল পেশ করা হচ্ছে, সেই সংসদে একজনও মুসলিম সদস্য নেই। স্বাধীনতার এত বছর পর এই প্রথম শাসক জোট ভালোবেসে একজন মুসলিমকেও সংসদ সদস্য করতে পারল না বা বলতে পারি যোগ্য মুসলমান খুঁজে পেল না। নতুন আইনে ওয়াকফ বোর্ডের মাথায় বসবে ভিন্ন সম্প্রদায়ের দুজন সদস্য। কল্পনা করুন, দিল্লি দাঙ্গার জন্য সন্দেহভাজন একজন মন্ত্রী ওয়াকফ সম্পত্তির দায়িত্বশীল কর্তা হলেন। তিনিই দরদ দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ালেন। এ রকম ফ্যান্টাসি শিশুও বিশ্বাস করবে না। মুসলিম সম্পত্তি নিয়ে এমন চিন্তায় শাসকরা বিভোর, তারা আড়ালে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য। শুধু দক্ষিণ ভারতের তিনটি রাজ্যেই দশ লাখ একর দেবোত্তর সম্পত্তি আছে। উত্তর, পশ্চিম রাজ্যগুলোর হিসাব আপাতত বাদ দিচ্ছি। বিজেপি দেবোত্তর সম্পত্তির বিবাদ-মীমাংসায় কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোককে কমিটির মাথায় বসাতে পারবে! এসবই নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের লোকজনকে তুষ্ট করা। দেখ দেখ আমরাই, সংঘীরাই পারি দেশে বহুত্ববাদী চিন্তাকে সমূলে উৎপাটিত করতে। বিজেপি শাসিত সব রাজ্যে আদিবাসী, সংখ্যালঘু, দলিতদের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে ওয়াকফ আইনের সংশোধনী আসলেই ল্যান্ড মাফিয়াদের সুবিধা করে দেবে। ১৯৪৭-এ নিশ্চয়ই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জমির অধিকারও সেখানে অন্যতম পয়েন্ট ছিল। ১৭৭৯-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। একরের পর একর লাখোয়াজ জমি হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন হয়েছিল অখণ্ড বঙ্গের একদা সচ্ছল মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশ। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই পরবর্তীকালে দাঙ্গা-হাঙ্গামার বাড়বাড়ন্ত। ভয় সেখানেই। কোথায় যেন ১৯৪৭-কে দেখতে পাচ্ছি।
ভারতের গণতন্ত্রের মূল শক্তি বহুত্ববাদ। সেখানেই ক্রমশ আঘাত মেরে মেরে স্বৈরতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। এদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে ১৯৯২, ২০০২ ও ২০২৫ সমান কলঙ্কজনক। বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাট গণহত্যা এবং ওয়াকফ সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভালো না থাকলে কোথাও কখনোই সংখ্যাগুরু নিশ্চিন্তে দিনযাপন করতে পারে না। ভারতের সংখ্যালঘু আজ সত্যিই বড় অসহায়।
সৌমিত্র দস্তিদার : প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক