
প্রিন্ট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম
বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় নতুন হাইপ

মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বর্গভূমি। বিশ্বব্যাপী এর স্বীকৃতি মডারেট মুসলিম দেশ হিসাবে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষ নিয়ে এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে তাদের বসবাস। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ ও সৌন্দর্যও। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বেশ প্রভাব ও ছোঁয়া রয়েছে। এর বিপরীতে দেশটিতে গণ্ডগোল পাকাতেও সময়ে সময়ে ইস্যু করা হয় সাম্প্রদায়িকতাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা রাজনৈতিক। আবার ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে অঘটন ঘটিয়ে রাজনৈতিক মোড়ক দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কখনো কখনো বড় রকমের ইস্যু আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক গোলমাল বাঁধানোর কাণ্ডকীর্তি এ অঞ্চলে বেশ কবার হয়েছে। সেনা, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতায় সে অপচেষ্টা মারও খেয়েছে। এরপরও থেমে নেই অপচেষ্টাটি। সামান্য সুযোগ পেলেই খাবলে ধরার মতো লয়ে পড়ে মহলবিশেষ।
কিছুদিন আগে একটি মিশন চালানো হয়েছিল ভারত সফরে আসা মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের ওপর ভর করে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ বলে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মহলটি বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান বদলে গেছে-এ মর্মে তাদের প্রচারণা তুঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায় অল্প কদিনেই। ট্রাম্পের সেন্ট্রাল প্রশাসন থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বর্তমান সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
ওই বাস্তবতায় সে যাত্রায় ব্যর্থ হয়ে এখন হাইপ তোলার অপচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের ঘাড়ে চড়ে। ‘বাংলাদেশ নতুন করে গড়ে উঠছে, ইসলামি কট্টরপন্থিরা সুযোগ খুঁজছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকে পুঁজি করে আবার একটা নাড়া দেওয়ার আয়োজন যে কারোরই বোধগম্য। বিভ্রান্তিকর ও একপক্ষীয় মন্তব্যশ্রায়ী তথ্য দিয়ে হাইপ তোলার এ প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকারান্তরে একটি প্রবন্ধ। যার বর্ণনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতি সরলীকৃতভাবে দেখানো হয়েছে। সেইসঙ্গে অস্বীকার করা হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে। বাছাই করা কিছু ঘটনা তুলে ধরে সাজানো প্রবন্ধটিতে রক্ষণশীল আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের নারী উন্নয়নে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি, সেখানে নারীদের দেখানো হয়েছে অনগ্রসর করে। এবারের যুব উৎসব ২০২৫ এখানে উদাহরণ হিসাবে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে অংশ নিয়েছে। তিন হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে নারীরা। এ বিশাল ইভেন্টে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী তরুণী ও বিভিন্ন স্তরের নারীদের যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণবন্ততা প্রমাণ করে। একটি মাত্র ফুটবল খেলা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া মানে এই নয় যে, বাকি দুই হাজার ৯৯৯টি সফল আয়োজনের মূল্য নেই। টাইমস তা-ই বোঝানোর চেষ্টা করেছে। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে গোটা অগ্রগতিকে খাটো করে দেখানো মোটেই সাংবাদিকতা নয়। এটি চাতুরির রাজনীতি।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার উপরে। টাইমসের প্রতিবেদনে এর সামান্যতম উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের নারীরা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের লিঙ্গসমতা সূচকে ৭৩তম অবস্থানে বাংলাদেশ। নারী ফুটবল ও ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪০ শতাংশ কর্মকর্তা নারী। পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে হাজারো নারী কাজ করছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো একজন নারী মেজর জেনারেল হয়েছেন। অথচ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ধর্মীয় সহিংসতা হিসাবে চিত্রিত করার অপচেষ্টাও চালানো হয়েছে। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা মূলত রাজনৈতিক এবং এর অনেক ঘটনাকে ধর্মীয় সংঘাত হিসাবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই জনসমর্থন পেতে ধর্মকে ব্যবহার করে, যা সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলে। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়ন বলে চালানোর মওকা খোঁজা হয়। টাইমসেও তা করা হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর দিনতিনেক বাংলাদেশ ছিল পুলিশহীন, কার্যত সরকারহীন। এ সময়টায় সাম্প্রদায়িক গোলমালসহ সামাজিক গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা চলে। বিস্ময়করভাবে ছাত্র-জনতা, আলেম-ওলামারা তখন নিজ থেকেই এগিয়ে আসে ঐক্যের আলোকবর্তিকা হয়ে। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে গেছে কারও নির্দেশ ছাড়াই। পাহারা দিয়েছে মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দায়বদ্ধতা ও ঐক্যের ওই বাতাবরণ অটুট থাকলে এখন ঐক্য-ঐক্য করে মাথা পানি করতে হয় না। ৮ আগস্ট ক্ষমতা নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষাকে টপ প্রায়োরিটি হিসাবে নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সেনা-জনতা এক কাতারে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশে চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটি লাল সংকেত। এরপরও দেশে চরমপন্থার উত্থানের গল্প সাংবাদিকতার অপমান।
উগ্রবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। এর জেরে গণতন্ত্র একটি নতুন চ্যালেঞ্জে। বাংলাদেশ আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে তা মোকাবিলায় আগেভাগেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেখানে বিচ্ছিন্ন কিছু উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর বক্তব্য ও কার্যকলাপকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে পরিচায়ক করা দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা নারী ফুটবল বন্ধ করে দিয়েছে মর্মে পুরোনো রেকর্ডটি নতুন করে বাজিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, জয়পুরহাটে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজক কমিটি বিনা টিকিটে ফুটবল আয়োজনের অনুমতি নিলেও শর্ত ভঙ্গ করে টিনের বেড়া দিয়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে। এতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া মাঠের পাশে অশ্লীল নৃত্যের কারণে স্থানীয় কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। তবে মূলত টিকিট ব্যবস্থার অনিয়মের কারণে সেখানে বিশৃঙ্খলা ঘটে, যা নিয়ে মিডিয়ায় ভুলভাবে তথ্য ছড়ানো হয়। সেদিনের ম্যাচটি পরিত্যক্ত হলেও সাতদিন পর ম্যাচটি কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সংঘটিত হয়। অভিযোগ করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হয়রানির শিকার হন। তবে এটি একটি ব্যক্তিগত অপরাধ, ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়। দাবি করা হয়েছে, নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ বেড়েছে। সরকার হিজবুত তাহরিরের মতো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। গত এক বছরে ২০০ জনের বেশি উগ্রপন্থিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর যে মিছিলের কথা বলা হচ্ছে, তা বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি অপচেষ্টা, যা বর্তমান সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এখানে মুসলিম উগ্রপন্থিরা ছিল না, বরং হিন্দু উগ্রপন্থি সংগঠন ইসকনই সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে প্রবল আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত ধৈর্য দেখিয়েছে। দাবি করা হয়েছে নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে বহুত্ববাদ আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বহুত্ববাদ আনার দাবির বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং বহুত্ববাদ নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি।
বহুত্ববাদ একটি সামাজিক ধারণা, যা বিভিন্ন ধর্ম, মতাদর্শ ও সংস্কৃতির সহাবস্থান নিশ্চিত করে, কিন্তু এটি ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীত নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি এটি রাষ্ট্রীয় নীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। অতএব, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে-এমন তথ্য অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। বাংলাদেশ আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো উগ্রবাদী হচ্ছে তথ্যও একটি রটনা। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলো বলছে, মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশগুলোর একটি। এরপরও একের পর এক অভিযোগের তীর যখন ছোড়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার আবশ্যকতা রয়েছে।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন