
প্রিন্ট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
ইসরাইলে গৃহযুদ্ধ আসন্ন!

ড. রামজি বারুদ
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
বর্তমানে ইসরাইলি রাজনীতিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর অন্যতম হলো ‘গৃহযুদ্ধ’। কথাটি এক সময় ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের মুখ দিয়ে বের হতো। এখন তা দেশটির মূলধারার রাজনৈতিক সমাজের কাছে অনেকটাই গ্রহণযোগ্য পরিভাষায় পরিণত হয়েছে। গত ২৪ মার্চ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট নিউইয়র্ক টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, (ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন) ‘নেতানিয়াহু নিজের টিকে থাকার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, আর জনগণ যতটুকু বুঝতে পেরেছে, তার চেয়েও বেশি গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’
গৃহযুদ্ধের ভয়টি ইসরাইলের রাজনৈতিক মেরুকরণে প্রতিফলিত হচ্ছে : দুটি গ্রুপ যুদ্ধ, সরকারের ভূমিকা, বিচার বিভাগ, বাজেট বরাদ্দ এবং অন্যান্য ইস্যুতে বিভক্ত। তবে এমন ধারণা পুরোপুরি নির্ভুল নয়। সব দেশই রাজনৈতিক রেখা বরাবর বিভক্ত হলেও বিক্ষোভ ও নিরাপত্তা বাহিনীর দমন অভিযান গৃহযুদ্ধ আসন্ন হওয়ার নিশ্চিত সূচক নয়।
ইসরাইলে গৃহযুদ্ধের শঙ্কাটি সৃষ্টি হয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক-জাতিগত বিন্যাস থেকে। ইসরাইলের মতো দেশে গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং এর রেশ ধরে রাজনৈতিক বিভাজন নিয়ে সিআইএ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল-‘ইসরাইল; দ্য সেফারদি-আশকেনাজি কনফ্রন্টেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশন্স’ নামে। প্রতিবেদনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও তেমনভাবে প্রচারিত না হওয়ায় অনেকটাই গোপন রয়ে গেছে। প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছিল ১৯৮২ সালে। তবে প্রকাশ করা হয় ২০০৭ সালে। এতে ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত ইসরাইলি নির্বাচনের ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ওই নির্বাচনে মেনাহেম বেগিনের নেতৃত্বাধীন লিকুদ পার্টি নেসেটে ৪৮টি আসন পেয়েছিল। আর লেবারের শিমন পেরেস জিতেছিলেন ৪৭টি আসনে।
ইসরাইলে ক্ষমতার সব বিভাগে আশকেনাজি (পাশ্চাত্য) ইহুদিরা কয়েক দশক ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এ গ্রুপের কাছে ইহুদিবাদ হলো অবশ্যই একটি পাশ্চাত্য-প্রভাবিত মতাদর্শ। আর সামরিক বাহিনী (হাগানা), পার্লামেন্ট (নেসেট), উপনিবেশ (জিউশ এজেন্সি) এবং অর্থনীতি (হিস্টাদ্রুত)-সবই মূলত ইউরোপিয়ান ইহুদিদের নিয়ে গঠিত।
সেফারদি ও মিজরাহি ইহুদিরা মূলত আরব মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা। ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করার পর প্রতিষ্ঠিত ইসরাইলে তারা এসেছিল। ততদিনে অবশ্য আশকেনাজিরা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল, ইসরাইলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছিল। তারাই তখন প্রধান প্রধান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বেগিনের ১৯৭৭ ও ১৯৮১ সালের নির্বাচনি বিজয় ছিল আশকেনাজি আধিপত্যের বিরুদ্ধে কঠোর ও শ্রমসাধ্য যুদ্ধের ফল। বিভিন্ন ডানপন্থি গ্রুপের জোট লিকুদদের সঙ্গে কয়েকটি ধর্মীয় দলও ছিল। অ-আশকেনাজি রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে এর চার বছর আগে লিকুদ পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রান্তিক মতাদর্শ ও জাতিগত গ্রুপগুলোর দুর্দশাকে পুঁজি করে লিকুদরা আশকেনাজি-প্রাধান্যপূর্ণ লেবার পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
আর ১৯৮১ সালের নির্বাচন ছিল ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য লেবারদের বেপরোয়া প্রয়াস। এ নির্বাচন পরের অনেক নির্বাচনের জন্য নিয়ম ঠিক করে দেয়, ইসরাইলি রাজনীতি জাতিগত বিন্যাসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পূর্ব বনাম পাশ্চাত্য, ধর্মীয় উগ্রবাদ বনাম জাতীয়তাবাদী চরমপন্থা ইত্যাদি পরিভাষায় লড়াই চলে। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ বিভাজন সামাল দিতে ইসরাইল বাইরের সংকট তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৮২ সালের লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কিছু সময়ের জন্য হলেও ইসরাইলের নজর সামাজিক অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়।
বেগিন ও তার সমর্থকরা ইসরাইলি রাজনীতিকে নতুন পথে চালিত করলেও আশকেনাজি-প্রাধান্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীরে প্রোথিত আধিপত্যের কারণে পাশ্চাত্যের ‘ওয়েস্টার্ন লিবারেলরা’ দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ, শিন বেত (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা) এবং অন্য বেশির ভাগ খাতে প্রাধান্য বিস্তার অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়।
সেফারদিক রাজনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রধানত অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ-সুবিধা ও তহবিল বাড়ানোর দিকে নজর দিয়ে থাকে। ১৯৭৭ সালে বেগিনের জয়লাভের পর প্রধান প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেফারদিকের প্রভাব বাড়ে।
নেতানিয়াহুর ১৯৯৬ সালের জোটের জয়লাভের মাধ্যমে ইসরাইলের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার উত্থান শুরু হয়। এর মাধ্যমে সেফারদিক ও মিজরাহিদের সঙ্গে জোট গঠনের কাজেরও সূচনা হয়। নতুন শক্তির ঘাঁটি রক্ষার জন্য লিকুদদের দলের মধ্যে সেফারদিক ও মিজরাহিদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হয়।
এটা ঠিক যে, পশ্চাৎপদ আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও জাতিগত গ্রুপগুলোর দুর্দশাকে পুঁজি করে নেতানিয়াহু ইসরাইলি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও নিজস্ব গতিশীলতার জের ধরে দেশটির রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন হয়ে যায়। সিআইএর প্রতিবেদনে এ বিষয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল।
এর মধ্যেই নেতানিয়াহু এবং তার মিত্ররা ইসরাইলের রূপান্তরের গতি বাড়িয়ে দেন। আশকেনাজিদের শক্তি স্থায়ীভাবে প্রান্তিক করার জন্য নেতানিয়াহুরা ইসরাইলের সূচনা থেকে ইউরোপীয় ইহুদিদের প্রভাবে থাকা সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
বিষয়টি মোটামুটিভাবে শুরু হয় সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহুর বিদ্রোহ এবং ২০২৩ সালের মার্চে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে বরখাস্ত করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। এরপর সৃষ্ট ব্যাপক বিক্ষোভ ক্রমবর্ধমান বিভাজনকে প্রকট করে। গাজার যুদ্ধ বিভক্তি বাড়িয়ে তোলে। নেতানিয়াহু এবং তার মিত্ররা তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার একটি সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেন ৭ অক্টোবরের ঘটনাপ্রবাহকে। তারা বিচার বিভাগকে টার্গেট করে পাশ্চাত্যের ইহুদিবাদীদের দর্শনে গড়া ইসরাইলকে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার কাজ শুরু করে। আশকেনাজিরা তাদের রাজনৈতিক শক্তির বেশির ভাগ খোয়ালেও তারা তাদের হাতে অর্থনৈতিক কার্ডগুলো মোটামুটিভাবে বহাল রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর এর মাধ্যমে তারা ভয়াবহ ধর্মঘট এবং নাগরিক আন্দোলন শুরু করিয়ে দিতে পারে।
নেতানিয়াহু এবং তার সমর্থকদের জন্য সমঝোতা সম্ভব নয়। কারণ এটা ১৯৮০-এর দশকে শুরু হওয়া ভারসাম্যপূর্ণ কাজই ফিরে আসার ইঙ্গিত দিতে পারে। আর আশকেনাজি শক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করার অর্থ হলো ডেভিড বেন-গুরিয়ান, চাইম ওয়েজম্যান এবং অন্যদের দেখানো ইসরাইলের সমাপ্তি, খোদ ইহুদিবাদের সমাপ্তি।
সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দৃশ্যপটে দেখা না যাওয়ায় ইসরাইলে গৃহযুদ্ধই প্রকৃত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। হয়তো গৃহযুদ্ধ একেবারেই আসন্ন হয়ে পড়েছে।
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ
ড. রামজি বারুদ : আমেরিকান-ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও লেখক