
প্রিন্ট: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১৭ পিএম
এ ভূমিকম্প কেন এত বিধ্বংসী

রবিন জর্জ অ্যান্ড্রুস
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
২৮ মার্চ স্থানীয় সময় দুপুরের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েক কোটি মানুষ অনুভব করে, তাদের পায়ের নিচে মাটি তীব্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে। মিয়ানমারের মান্দালয়ের প্রায় ১২ মাইল দূরে কেন্দ্রীভূত ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি এ অঞ্চলকে কাঁপিয়ে দেয়, অনেক রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেক প্রাচীন প্যাগোডা ধসে পড়ে, অনেক ব্রিজ ভেঙে যায় এবং অনেক বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এলাকাগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
শক্তির হিসাবে ভূমিকম্পটি ছিল কয়েকশ পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণের সমান। ইকুয়েডরের গায়াকিলে ভিসেন্টে রোকাফুয়ের্তে সেকুলার ইউনিভার্সিটির ভূমিকম্প বিশারদ বিজ্ঞানী আমিলকার ক্যারেরা-সেভালোস বলেন, ‘এ ভূমিকম্পের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তা অনুভূত হয়।’ ব্যাংককে একটি নির্মাণাধীন ৩০ তলা ভবন, যেটি ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ৬০০ মাইল দূরে ছিল, সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের আনুমানিক তথ্য অনুযায়ী, এ ভূমিকম্পে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষের হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে কয়েকশ কোটি ডলারের। এই ভূমিকম্পকে বিপর্যয়ে পরিণত করার পেছনে অনেক কারণও অবশ্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এখানকার ভবনগুলোয় ভূমিকম্প-প্রতিরোধক ব্যবস্থা না থাকা। কিছু ভবন তো এই শক্তিশালী ভূমিকম্পের চাপ সইতেই পারেনি।
মিয়ানমারের ভূমিকম্পের কারণ কী
প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বছর আগে ভারতীয় টেকটনিক প্লেটের সঙ্গে ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ ঘটে এবং পরে প্রথম প্লেটটি দ্বিতীয়টির নিচে নামতে শুরু করে। মাঝখানের ভেঙে যাওয়া ভূত্বককেই আমরা আজ হিমালয় বলে জানি। এই পর্বতমালা ও পুরো অঞ্চলটি সেই মহাজাগতিক সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া ফাটলগুলোতে ভরা। ভারতীয় প্লেট এখনো খুব ধীরে ইউরেশিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং সেই অসংখ্য ফাটলের ফলে প্রচুর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে তারা ভেঙে যায়।
গত ২৮ মার্চে যে ভূমিকম্পটি হয়েছে, তার কেন্দ্রস্থলে বিশাল একটি ফাটল ছিল, একটি নির্দিষ্ট বিভাজন বরাবর। প্যারিসের আর্দ ফিজিক্স ইনস্টিটিউটের ভূমিকম্প বিশারদ বিজ্ঞানী রবিন লাকাসিন বলেন, সব প্রাপ্ত তথ্য এখনো দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করছে যে, এটি সাগাইন ফল্টের একটি ফাটলের ফলে হয়েছে। এটি প্রধানত উত্তর-দক্ষিণ ‘স্ট্রাইক-স্লিপ’ ফাটল, যেখানে ভূত্বকের দুটি ব্লক একে অপরের পাশ দিয়ে সরে যায় (ক্যালিফোর্নিয়ার সান অ্যান্ড্রিয়াস ফল্টের মতো)। লাকাসিন আরও বলেন, সাগাইন ফল্ট ভারতীয় প্লেটের ওই পাশের প্রধান স্ট্রাইক-স্লিপ সীমানা। এবং এটি অতীতে অনেক শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পের জন্য দায়ী।
হাবার্ড উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের মে মাসে একই ফাটল ভেঙে গিয়ে ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেছিল। এটি বিশেষত বিপজ্জনক ফাটল, কারণ এটি সরাসরি মিয়ানমারের রাজধানীর নিচে অবস্থিত। আজকের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ২০২৩ সালের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।
বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করা হয় ভূ-পৃষ্ঠের কাঁপনের তীব্রতা নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই ভূমিকম্পের ‘তীব্রতা’ অনুভব করেছে। অনেক ভবন শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হয়নি, স্থানচ্যুতও হয়েছে। কিছু ভবন সত্যিই তার ভিত্তি থেকে সরে গেছে। কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে কাঁপনের তীব্রতা এতটাই শক্তিশালী ও গুরুতর ছিল যে, সেখানকার ভবনগুলোর ক্ষয়ক্ষতি দেখে থাইল্যান্ডের মানুষ তো বটেই, বিশ্ববাসীও হতবাক হয়েছে।
মিয়ানমারের ভূমিকম্প এত ক্ষতিকর কেন
এমন ভূমিকম্পগুলো ভয়াবহ স্মৃতি হিসাবে কাজ করে, কারণ এ ধরনের বিপর্যয়কে শুধু ‘প্রাকৃতিক’ বলা যায় না। এর পেছনে আমাদেরও দায় আছে। এটা সত্য যে, শুক্রবারের ভূমিকম্পটি শক্তিশালী ছিল; কিন্তু এটাও সত্য, যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে সম্পর্কে আগাম সচেতনতা থাকলে তা অনেকাংশে রোধ করা যেত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভূমিকম্পটি যে এলাকায় ঘটেছে, সেখানে ভূমিকম্প-প্রতিরোধক ভবন নেই এবং নির্মাণ কোড খুব কমই মানা হয়ে থাকে। আসলে আপনি ভবন নির্মাণের সময় সেভাবেই তার ডিজাইন করবেন, যাতে সেটি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এমনকি পুরোনো স্থাপনাগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের ভূমিকম্প-প্রতিরোধক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পুনর্নিমাণ করা যেতে পারে।
থাইল্যান্ডের ক্ষতি অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর; কিন্তু খুব গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা নেই। সেখানে কাঁপনের তীব্রতা মিয়ানমারের তুলনায় কম ছিল এবং থাইল্যান্ডে যে উঁচু ভবনটি ভেঙে পড়েছিল, তা নির্মাণাধীন ছিল, তাই এটি সম্ভবত একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। হাবার্ড বলেন, আমরা বরং মিয়ানমারে আরও খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছি। কারণ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কাজ করবে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থান এবং চলমান গৃহযুদ্ধ ইতোমধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। এই ভূমিকম্প ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেবে, ইতোমধ্যে বিস্তৃত মানবিক সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে। শক্তিশালী আফটার-শকগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে শহর, বন্দর ও গ্রামগুলোকে কাঁপিয়ে তুলবে। সম্ভবত অরাজক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টাকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান থেকে ভাবানুবাদ : খালিদ বিন আনিস
রবিন জর্জ অ্যান্ড্রুস : বিজ্ঞানী ও লেখক, লন্ডন