
প্রিন্ট: ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪২ এএম
সংগ্রামী সিরাজুল হোসেন খান

মোস্তাফিজুর রহমান খান
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
জীবনে প্রাপ্তি ও পূর্ণতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চিরদিনের হলেও প্রত্যেকের ক্ষেত্রে তা একই রূপে আবির্ভূত হয় না। কারও কারও জীবন প্রাপ্তি ও পূর্ণতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে টিকে থাকে-মানুষ সে জীবনকে ভালোবেসে শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয় এবং স্মরণের জগতে লালন করে। তেমনই একজন মানুষ সিরাজুল হোসেন খান। তিনি ছিলেন মেহনতি কৃষক, শ্রমিক ও জনতার এক অকৃত্রিম বন্ধু, এক অমিততেজ সংগ্রামী নেতা। তিনি অন্যায় সহ্য করেননি, প্রতিবাদ করেছেন সুউচ্চ কণ্ঠে। নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ছিল তার।
বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গনের কিংবদন্তি নাম সিরাজুল হোসেন খান বৃহত্তর সিলেটের বানিয়াচং গ্রামে ১৩৩৩ বাংলা সালের ১ শ্রাবণ (১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই) এক বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় সিরাজুল হোসেন খান পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (পরে ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ১৯৪৮ জানুয়ারিতে ছাত্ররাজনীতিতে যোগদান করেন। বছর দুই পর তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে আগস্টে ছাত্রাবস্থায় তিনি তৎকালীন ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার (বর্তমান বাংলাদেশ অবজার্ভার) পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৫০ সালে ইসলামের ইতিহাসে এমএ পাশ করার পরের বছর দৈনিক অবজারভার ছেড়ে পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান) সরকারের প্রচার বিভাগে যোগদান করেন এবং অ্যাসিসটেন্ট ডাইরেক্টর অব পাবলিসিটি হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬১ সালে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে দৈনিক পাকিস্তান টাইমসের (লাহোর) ‘ঢাকা করোসপনডেন্ট’ ও ‘ব্যুরো চিফ’ হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকে দেশের বৃহত্তর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সব দল ও মতের শ্রমিক ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলোর যৌথ সম্মেলনে গঠিত ঐক্যবদ্ধ সংস্থা ‘পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদে’র (ইস্ট পাকিস্তান ওয়ার্কার্স কাউন্সিল) সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব-পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বহু শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ও ঘেরাও আন্দোলনে তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৭-৬৯ সালে তিনি দুবার ১৪ মাস কারারুদ্ধ থাকেন এবং পাকিস্তান আমলে দশ বছরাধিক কাল আত্মগোপনে কাটান। ১৯৬৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর সিরাজুল হোসেন খান বেসরকারি খাতে একটি সংবাদ সংস্থা ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (এনা) গড়ে তোলেন। এনার তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ইতঃপূর্বে প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা টাইম্স দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে স্থাপিত পাকিস্তান ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (ইস্ট জোন) প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন।
সিরাজুল হোসেন খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও’ দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাদের উদ্যোগে ঢাকা অঞ্চলে দুদিনের মধ্যেই দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া আইয়ুব খানের গণবিরোধী পরিকল্পনা প্রতিরোধের জন্য ১৯৬৪ সালের মার্চে গঠিত ‘সর্বদলীয় ভোটাধিকার সংগ্রাম পরিষদে’র সম্পাদক ছিলেন সিরাজুল হোসেন খান। এ সর্বদলীয় কমিটি সর্বজনীন ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ১৯৬৪ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় হরতাল আহ্বান করে। তখন সারা ঢাকা শহরে আইয়ুববিরোধী প্রথম হরতালটি পালিত হয়।
মওলানা ভাসানী ভারত সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্য গঙ্গা ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ ঘোষণা করেন। ১৬ ও ১৭ মে (১৯৭৬) অনুষ্ঠিত এ লং মার্চে সারা দেশ থেকে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটে। রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে ১৬ মে মওলানা ভাসানীর এক তেজোদীপ্ত ভাষণ শেষে লক্ষাধিক লোক ফারাক্কার দিকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে। দুদিন ব্যাপী এ লং মার্চয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল হোসেন খান। মজলুম জননেতা ভাসানীর সমর্থক সব রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন এ মার্চে অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সারা দেশের প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তির সমাবেশ ঘটানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ১৯৭৩-এর ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় এক বিরাট সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশকে সভাপতি, শ্রমিক নেতা সিরাজুল হোসেন খানকে সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্র নেতা মাহবুব উল্লাহকে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক করে এ নবগঠিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। এ নতুন পার্টি শুরু থেকেই বাংলাদেশের জনগণের আর্থসামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সব বিদেশি শোষণ আধিপত্য, বিশেষ করে ভারতীয় আধিপত্যবাদী তৎপরতা কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য জনমত গড়ে তুলতে থাকে।
জাগমুইসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে গণতান্ত্রিক পার্টি গঠিত হয়। এ পার্টির স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ছিলেন নূরল হুদা মির্জা। স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিলেন সিরাজুল হোসেন খান, এনায়েতউল্লাহ খান, আব্দুল মতিন, আনোয়ার জাহিদ প্রমুখ নেতা। পরে সিরাজুল হোসেন খান এ পার্টির সভাপতি এবং আনোয়ার জাহিদ সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পার্টি ইউপিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে গঠিত হয় জাতীয় ফ্রন্ট। জাতীয় ফ্রন্টের সদস্য হিসাবে সিরাজুল হোসেন খান ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি মৎস্য, ভূমি, শ্রম ও জনশক্তি, ত্রাণ এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
জলমহালে জেলেদের অধিকার রক্ষার জন্য তিনি ‘জাল যার জলা তার’ নীতি বাস্তবায়ন করেন। জলমহালের চারপাশে বসবাসরত জেলেরাই সংশ্লিষ্ট জলমহালে মৎস্যচাষ করবেন এ মর্মে তাদের ‘অধিকারপত্র’ প্রদান করা হয়। ১৯৯০ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট এ বিরাট মৎস্যজীবী সমাবেশে ‘জাল যার জলা তার’ নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। এ সমাবেশের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ। প্রধান বক্তা এবং সম্মেলনের প্রধান সংগঠক ছিলেন সিরাজুল হোসেন খান। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এ ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ ইতঃপূর্বে লক্ষ্য করা যায়নি। উল্লেখ্য যে, ‘জাল যার জলা তার’ নীতির আওতাধীন জলমহালগুলোর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে এ নীতি আর কার্যকর থাকেনি।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বার্থ ও সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে যে কয়জন নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন সিরাজুল হোসেন খান তাদের অন্যতম। কিন্তু সাংবাদিকতার মোহের জগৎ তাকে বন্দি করে রাখতে পারেনি শুধুই লেখালেখির জগতে। তিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন মেহনতি মানুষের পাশে, গড়ে তুলেছিলেন আন্দোলন। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সিরাজুল হোসেন খান ছিলেন দূরে-আর এ কারণেই বিভিন্ন আন্দোলন আর সংগ্রামকে দেখেছেন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই জাতীয় মুক্তির জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে তার কোনো দোদুল্যমানতা ছিল না। ভেবেছিলেন দেশের স্বাধীনতার ফলে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয় সূচিত হবে। এ কারণেই স্বাধীনতার পরপর ফিরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকতার জগতে-শ্রম আর মেধা দিয়ে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন একেবারেই বাংলাদেশি বার্তা সংস্থা। কিন্তু অনেকের মতো তারও স্বপ্ন ভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। তাই ফিরে এসেছিলেন গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন। স্বাধীন বাংলাদেশে নিজস্ব রাজনৈতিক দল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে চোখ ধাঁধানো সাফল্য না এলেও, যে অঙ্গীকার ছিল তার অন্তর্গত, সেখান থেকে তিনি ফিরে যাননি। এ কারণেই স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি ছিলেন সক্রিয়ভাবে জড়িত। সিরাজুল হোসেন খান জাতীয় পার্টি ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন ১৯৯৭ সালে। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
মোস্তাফিজুর রহমান খান : সাবেক ছাত্রনেতা