
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৫ এএম

ড. সোহেল মিয়া
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
দেশের শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষ একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষত ঈদ উৎসবের প্রাক্কালে শ্রমিকরা বেতন, বোনাস, ওভারটাইম এবং উৎসব ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন। ঈদের সময় পরিবার-পরিজনের জন্য কেনাকাটা এবং গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাড়ানোর কারণে শ্রমিকদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। তবে অনেক সময় মালিকপক্ষ সময়মতো বেতন ও বোনাস পরিশোধে ব্যর্থ হয়, যা শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হয়ে ওঠে। এর ফলে শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সরকারের কার্যকর ভূমিকা এবং শ্রম আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। দ্রুত ও কার্যকর সমাধানের জন্য শ্রমিক, মালিক ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। কেবল পারস্পরিক আস্থা, সময়মতো বেতন ও বোনাস পরিশোধ এবং শ্রম আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমেই এ ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব।
শ্রমিক অসন্তোষের কারণ
শ্রমিক অসন্তোষের অন্যতম প্রধান কারণ হলো সময়মতো বেতন ও বোনাস পরিশোধ না করা। দেশে এ সমস্যা নিয়মিত দেখা যায়, বিশেষ করে উৎসবের সময়, যেমন ঈদের আগে। মালিকপক্ষ আর্থিক সংকট বা নগদ অর্থের অভাব দেখিয়ে বেতন পরিশোধে বিলম্ব করে, যা শ্রমিকদের আর্থিক দুর্ভোগ এবং পারিবারিক সমস্যায় ফেলতে পারে। এ বিলম্ব শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, যা বিক্ষোভ বা আন্দোলনে রূপ নিতে পারে এবং এর ফলে কর্মস্থলে অস্থিরতা ও উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে, যা শিল্প খাত ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত উৎসব-ছুটি নিশ্চিত না করা শ্রমিক অসন্তোষের আরেকটি বড় কারণ। বাংলাদেশ শ্রম আইনে উৎসবের জন্য ছুটি পাওয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু অনেক সময় উৎপাদন লক্ষ্য ও জনবল সংকটের কারণে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বিশেষ করে ঈদের আগে অতিরিক্ত ওভারটাইমের চাপ শ্রমিকদের ক্লান্ত করে এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ না পাওয়ায় পারিবারিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অপর্যাপ্ত ছুটি কর্মস্থলে অনীহা সৃষ্টি করে এবং শিল্প খাতে অস্থিরতা বাড়ায়।
ঈদের আগে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কারখানা বন্ধ করে দেয় বা শ্রমিকদের লে-অফে পাঠায়, যার ফলে শ্রমিকদের আয় কমে যায় এবং আর্থিক দুর্দশা সৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের সংকট দেখিয়ে ছুটিতে পাঠানো হয়, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক চাপ বাড়ায়। এ পরিস্থিতি শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন, ওভারটাইম, ছুটি ও বোনাস পাওয়ার অধিকার থাকলেও অনেক মালিকপক্ষ আইন মানতে গড়িমসি করে। শ্রমিকরা আইন সম্পর্কে অবগত না থাকায় তাদের অধিকার চেপে রাখা হয় এবং প্রশাসনের দুর্বল তদারকির কারণে মালিকরা আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে শ্রমিকদের পাওনা আটকে রাখে। এ পরিস্থিতি শ্রমিকদের বিক্ষোভ বা ধর্মঘটে অংশগ্রহণে বাধ্য করে, যা শিল্প খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
শ্রমিকদের অভিযোগ ও দাবি সমাধানে প্রশাসনিক ব্যর্থতা একটি বড় বাধা। শ্রম পরিদর্শকদের দুর্বল মনিটরিং ও শিল্পপুলিশের অপর্যাপ্ত ভূমিকার কারণে সমস্যার দ্রুত সমাধান হয় না। রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপও পরিস্থিতি জটিল করে তোলে, ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক প্রভাব শ্রমিক অসন্তোষের বড় কারণ হতে পারে। হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটের মতো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করে এবং শ্রমিকদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক বাজারের সংকট বা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে চাকরির অনিশ্চয়তা বাড়ে, যা উদ্বেগ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কিছু গোষ্ঠী শ্রমিক আন্দোলনকে উসকে দিলে তা শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র করে।
শ্রমিকদের দাবি ও অভিযোগের দীর্ঘদিন সমাধান না হলে তাদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। প্রশাসন ও মালিকপক্ষের উদাসীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ট্রেড ইউনিয়নের দুর্বলতার কারণে সমস্যার সমাধান হয় না। এতে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পেশাদার মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভাবে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা কম থাকে, যা তাদের কর্মজীবনে উন্নতির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। মালিকপক্ষ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে যোগাযোগের অভাব, শ্রমিকদের দাবি উপেক্ষা এবং মতামত গ্রহণের অভাব অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এর ফলে চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা ও আন্দোলনের সম্ভাবনা বাড়ে, যা উৎপাদনশীলতা কমিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি করতে পারে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশের অভাব শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। নিরাপত্তা, বিশ্রামের সুযোগ, পানীয় জল, প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাব তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, যা তাদের কর্মবিরতি বা ধর্মঘটের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
দ্রুত সমাধানের কৌশল
মালিক-শ্রমিক সমঝোতা বাড়ানোর মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস ও সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হয়। নিয়মিত আলোচনা সভা এবং বিশেষ করে ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে আলোচনা করা শ্রমিকদের উদ্বেগ কমাতে এবং কর্মক্ষেত্রে একটি সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে। বেতন ও বোনাস প্রদানের নির্ধারিত সময়সীমা নিশ্চিত করা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের উচিত, ঈদের অন্তত ৭ দিন আগে শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ উদ্দেশ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কারখানা মালিকদের জন্য নির্দিষ্ট কঠোর নির্দেশনা জারি করা প্রয়োজন, যাতে তারা সময়মতো শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করে।
শিল্পপুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা শ্রমিক অসন্তোষ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পপুলিশকে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে হবে এবং যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনও শ্রমিকদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি হটলাইন চালু করতে পারে, যাতে শ্রমিকরা সহজেই তাদের সমস্যা ও দাবি জানাতে পারেন।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একটি কার্যকর কৌশল, যা দ্রুত এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে পারে। মালিকপক্ষ, শ্রমিক প্রতিনিধি ও সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা ও মধ্যস্থতা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা যেতে পারে, যা তাদের আর্থিক সংকট, স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা করবে। এর মাধ্যমে শ্রমিকরা দ্রুত সমাধান পাবে এবং নিরাপত্তা ও আস্থার অনুভূতি তৈরি হবে।
ট্রেড ইউনিয়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। এতে শ্রমিক নেতারা শ্রম আইন, আলোচনা কৌশল ও দ্বন্দ্ব নিরসন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবেন। কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারে এবং অপ্রয়োজনীয় শ্রমিক অসন্তোষ ও সংঘর্ষ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাস্তবায়ন পরিকল্পনা
শ্রম আইন কার্যকর করতে কঠোর মনিটরিং ও তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নির্ধারিত সময়ে বেতন ও বোনাস পরিশোধ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি কোনো মালিকপক্ষ অর্থ সংকটের অজুহাত দেখায়, তবে আলোচনার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে অন্তত আংশিক পরিশোধ নিশ্চিত করা উচিত, যাতে শ্রমিকরা ঈদে বাড়ি যেতে পারেন। পাশাপাশি, শিল্পপুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি করে শ্রমিক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা জরুরি।
শ্রমিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে মালিকপক্ষকে খোলামেলা আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যদি আর্থিক সংকটের কারণে বেতন ও বোনাস প্রদানে সমস্যা হয়, তবে শ্রমিকদের সঙ্গে স্বচ্ছভাবে আলোচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে আংশিক পরিশোধের মাধ্যমে তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নিরাপদে ঈদে বাড়ি ফিরতে পারে।
শ্রমিকদের উচিত অহেতুক উত্তেজনা বা সহিংসতার পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করা। উৎপাদন ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশের সম্পদ, প্রতিষ্ঠান বাঁচলে শ্রমিকরাও নিরাপদ থাকবে এবং জাতীয় অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।
ঈদ-পূর্ববর্তী শ্রমিক অসন্তোষ সমাধানে সরকার, মালিক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিল্প খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। এজন্য দ্রুত কার্যকর কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
ড. সোহেল মিয়া : শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ