আছিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু : মানবতার চরম বিপর্যয়

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
শেষ পর্যন্ত মাগুরার নির্যাতিত শিশু আছিয়াকে বাঁচানো গেল না। নির্মম নির্যাতনের প্রতীক আছিয়া চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পরপারে চলে গেছে। ধর্ষণের শিকার আছিয়া ৯ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করার পর গত ১৩ মার্চ বেলা ২টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছে। আছিয়ার মা মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘আমার মনি চলে গেছে।’ আছিয়া নির্মমতার শিকার হয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে উত্তরহীন এক প্রশ্ন-আমার মতো অবুঝ শিশুর কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই? আমাদের কি এভাবেই বিকশিত হওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী আছিয়ার ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড দাবি করে বলেছেন, আমরা যারা নারী ও শিশু আছি, তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে হবে অথবা জন্মের সময় জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলার অনুমতি দিতে হবে। একটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের এক নেত্রী বলেছেন, ধর্ষক কারও সন্তান নয়, ধর্ষক কারও ভাই নয়, তারা শুধুই ধর্ষক। এভাবে তিনি পরিবার থেকেই ধর্ষকের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্ষকের ব্যক্তিপরিচয় বা রাজনৈতিক পরিচয় অর্থহীন; তারা যে অপকর্ম সংঘটিত করে, তার সঠিক ও দ্রুত বিচার হতে হবে। ধর্ষকদের শাস্তি প্রদানের জন্য আইন আছে, কিন্তু সেই আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। একজন ধর্ষক নানাভাবেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দায়মুক্তি পেতে পারে। আর ধর্ষক যদি আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়, তাহলে তো কথাই নেই। প্রতিনিয়তই দেশে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আছিয়া চলে গেছে। তার ওপর পরিচালিত নির্মম নির্যাতন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু নিয়ে দেশব্যাপী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা ছিল নজিরবিহীন এবং আশা জাগানিয়া। সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করেছে। ‘আছিয়া’ এখন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যেমন সীমান্ত হত্যার প্রতীক হয়ে আছে ‘ফেলানী’। আগামীতে যুগ যুগ ধরে আছিয়া নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ হিসাবে বিদ্যমান থাকবে।
মাগুরার আছিয়ার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। এ বয়সে জীবনের জটিল দিক সম্পর্কে তার কোনো ধারণা থাকার কথা নয়। স্কুল রমজানের ছুটি ছিল। তাই আছিয়া তার বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ১ মার্চ। সেখানেই ৫ মার্চ আছিয়া ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষক আর কেউ নয়, তার দুলাভাইয়ের পিতা। অর্থাৎ আছিয়াকে তার ‘তালই’ ধর্ষণ করে। যে তালইকে আছিয়া পিতার মতো সম্মান করত, সেই জঘন্য ব্যক্তিটিই আছিয়ার এমন সর্বনাশ করেছে। সবচেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধর্ষণকাণ্ডে আছিয়ার দুলাভাই তার বাবাকে সহায়তা করে। কতটা নিু রুচির মানুষ হলে এমনটা করতে পারে, তা ভাবলেও বিশ্বাস হতে চায় না। ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার প্রায় ৯ ঘণ্টা পর ৬ মার্চ আছিয়াকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তাকে ফরিদপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। এক সময় তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আছিয়ার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। এক সময় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানে ১৩ মার্চ তার মৃত্যু হয়। আছিয়া ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর সারা দেশ আন্দোলনে সোচ্চার হয়। তারা ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। আছিয়া ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যমান আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মানুষ কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মম হলে ৮ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করতে পারে, তা অনুমান করতেও কষ্ট হয়। আছিয়ার ধর্ষণ ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অধঃপতনের চিত্রই ফুটে উঠেছে। দেশের আরও কোনো কোনো অঞ্চল থেকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ধর্ষণ যেভাবে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, অতীতে আর কখনোই এমনটি হয়নি। বিকৃতভাবে ধর্ষণের প্রবণতা বেড়েছে। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধের কারণগুলো আমাদের নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো অপরাধকর্ম নতুন নয়। সব সময়ই সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়ে চলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যাপকতা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ যেন ধর্ষণের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের কারও কারও মতে, গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পরিবর্তন সাধিত হলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব পালনের প্রতি অনীহা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দলীয় ক্যাডারের মতো ভূমিকা পালন করেছে। সেই অপকর্মের কারণে তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। যে কোনো সময় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। যারা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন, এখন তারা নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। একশ্রেণির পুলিশ সদস্য, যারা বিগত সরকার আমলে অনৈতিক সুবিধাভোগী ছিলেন, তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহের সুযোগে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে নানা কারণেই নারীদের পূর্ণ মাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ দমনের দাবিতে আন্দোলন করছে। এবার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষকরাও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে ধর্ষণবিরোধী এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মোতাবেক, ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুলাই সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে ১০ হাজার ৭০৪টি। একই বছর আগস্ট-ডিসেম্বর সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৬ হাজার ৮৬৭টি। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছরের (২০২৪) জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ৪৬৪টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আরও বেড়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুসারে গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ জানিয়ে কল এসেছে ৩৪৮টি। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে জানিয়েছে, গত বছর (২০২৪) নারী ও শিশু নির্যাতনের ২ হাজার ৫২৫টি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১ হাজার ৬৬৪টি এবং আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ৮৬১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন। অন্য একটি সূত্রমতে, গত ১০ বছরে ৫ হাজার ৬০০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিচারে অভিযুক্ত ধর্ষকের শাস্তি পাওয়ার হার খুবই কম। বিচারহীনতা ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে।
থানায় দায়েরকৃত মামলা এবং পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে ধর্ষণের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা যে কোনো বিবেচনায়ই উদ্বেগজনক। তবে এটাই শেষ বা চূড়ান্ত হিসাব নয়। কারণ ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই তা চেপে যান। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক বিচারের নামে অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। অপরাধের মাত্রা যদি ভয়াবহ না হয়, তাহলে কোনো অভিভাবকই তা প্রকাশ্যে আনতে চান না। কারণ কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন খবর প্রকাশিত হলে পরবর্তী সময়ে সেই পরিবারকে নানা সামাজিক জটিলতায় পড়তে হয়। এমনকি ধর্ষণের শিকার মেয়েকে পাত্রস্থ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়। কোনো ছেলের অভিভাবক তার ছেলের জন্য এমন একজন মেয়েকে বধূ হিসাবে গ্রহণ করবেন না। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হতে পারে। অথচ এর দায় যেন ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েটিরই। তাকে সামাজিকভাবে ধর্ষণের দায়ভার বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। যে বা যারা ধর্ষণের জন্য দায়ী, তারা সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় ধর্ষণের শিকার মেয়ের সামাজিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। তাকে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। ভাবখানা এমন যেন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার জন্য মেয়েটিই দায়ী। এ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুবই জরুরি। লক্ষণীয়, সমাজে যারা তুলনামূলক দরিদ্র পরিবারের সদস্য, প্রধানত তারাই অধিক হারে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বিত্তবান পরিবারের কন্যা শিশুরা সাধারণত তুলনামূলকভাবে কম ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ আর্থিক ক্ষমতায়ন নারী-শিশুদের ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ থেকে সমাজকে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেয়। যারা ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হন, তারা ভালোভাবেই জানেন, কোনো বিত্তবান পরিবারের একজন সদস্যকে নির্যাতন বা ধর্ষণ করলে তা থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আর যারা দরিদ্র পরিবারের সদস্য, তাদের ধর্ষণ করা হলে কোনো না কোনোভাবে তা থেকে দায়মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ। কোনো সভ্য সমাজে ধর্ষণের মতো নিন্দনীয় কাজ সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য আইন বিদ্যমান আছে। সেই আইনে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে আইন আছে, তার বাস্তবায়ন বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া ধর্ষণের বিষয়টি প্রমাণ করাও বেশ কঠিন। নির্যাতিতাকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অনেকেই আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য ধর্ষণের মামলা করতে চান না। কারণ এতে অনেক দিন পর্যন্ত আদালতে ঘুরতে হয়। এ ছাড়া আসামি পক্ষের আইনজীবী অনেক সময় অত্যন্ত আপত্তিকর প্রশ্নে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বিব্রত করার চেষ্টা করেন। এ জন্য নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের এবং বিচারপদ্ধতিকে আরও সহজ করা প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের ব্যবস্থা সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। ধর্ষণের বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রচলিত আইনে ধর্ষণের অভিযোগ তদন্তের জন্য ৩০ দিন বা এক মাস সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। এ সময়সীমা ১৫ দিন অর্থাৎ অর্ধেকে কমিয়ে আনা হবে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে বিচারকার্য সম্পন্ন করার সময়সীমা কমিয়ে ৯০ দিন করা হচ্ছে। প্রচলিত আইনে ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি প্রমাণের জন্য চিকিৎসক সনদের পাশাপাশি ডিএনএ সনদের প্রয়োজন হতো। প্রস্তাবিত আইনি সংশোধনীতে শুধু চিকিৎসকের সনদের ভিত্তিতে মামলা তদন্ত এবং বিচারকার্য সম্পন্ন করার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে কোনো তদন্ত কর্মকর্তা যদি ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার তদন্ত শেষ করতে না পারেন, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল করা হয়। পরে অন্য যাকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়, তিনিও যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্তকার্য শেষ করতে না পারেন, তাহলে আবারও নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনি সংস্কারে এ বিধান বাতিল করা হবে। যাকে তদন্তকাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তাকেই তদন্তকর্ম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হবে। আইন যত কঠোরই হোক না কেন, এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে কোনো কাজ হবে না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে।
যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আইনের সঠিক ও দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। আইন যেন তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু আইনি সংস্কারের মাধ্যমে নারী নির্যাতন বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আইনের প্রতিবন্ধকতাহীন প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন। মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন সাধন করতে হবে। ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন উভয়ের জন্যই আইনের একইভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনসহ যে কোনো গুরুতর অপরাধ দমনের জন্য আইনের সঠিক বাস্তবায়নের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন বা শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন, তাদের সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় বা পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানানো যাবে না। ধর্ষক পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করা যাবে না। যাদের বিরুদ্ধে কখনো ধর্ষণের মতো অন্যায়কর্ম করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠবে, তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। ধর্ষকদের সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় শিক্ষা করিকুলামে এমন বিষয় যুক্ত করতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীর মানবিক মূল্যবোধ এবং উদার চেতনা বিকাশে খুব একটা সহায়ক নয়। শিক্ষা কার্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে বিদ্যার্জনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা বিকশিত হয়। বাংলাদেশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে সব পর্যায়ে। এসব প্রযুক্তি আমাদের আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো শিশু বা কিশোরের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। মোবাইলে আপত্তিকর বিষয় পর্যবেক্ষণ করে একটি ছেলে বা মেয়ে বিপথে চালিত হতে পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।
আমরা যদি সামাজিকভাবে ধর্ষকদের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করতে পারি, তাহলে এক পর্যায়ে ধর্ষণের মাত্রা কমে আসবে। একইসঙ্গে অভিভাবককে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে-তার ছোট বাচ্চাটি কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে। ছোট বাচ্চারা সামান্য উপহার পেলেই সন্তুষ্ট হয়। তারা যেহেতু জীবনের জটিলতা বোঝে না, তাই তাদের প্রতারণা করা সবচেয়ে সহজ। একশ্রেণির মানুষরূপী ঘৃণ্য জানোয়ার সেই সুযোগটিই নিয়ে থাকে।
যে কোনো মূল্যেই হোক, ধর্ষণের মহামারি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে। তাহলেই কাক্সিক্ষত মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। ধর্ষক এবং সভ্য সমাজ কখনোই পাশাপাশি চলতে পারে না। এখনই সময় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐকবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আর কোনো আছিয়াকে যেন বিকশিত হওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত