ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয়

জেফ্রি ডি. স্যাশ
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
ইউক্রেনে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে রাশিয়া ও ইউক্রেন ইস্তান্বুলে একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরের প্রান্তে ছিল, যেখানে তুরস্ক সরকার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে নিরুৎসাহিত করেছিল এবং এর ফলে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় মারা গেছে বা গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। তবুও ইস্তান্বুল প্রক্রিয়ার কাঠামো আজকের শান্তির ভিত্তি হিসাবে কাজ করতে পারে।
খসড়া শান্তি চুক্তিটি (১৫ এপ্রিল, ২০২২) এবং এর ভিত্তিতে ইস্তান্বুল কমিউনিক (২৯ মার্চ, ২০২২) সংঘাতের সমাপ্তির জন্য একটি যুক্তিসংগত ও সরল পথের প্রস্তাব করেছিল। সত্য যে, ইউক্রেন আলোচনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তিন বছর পর, যার মধ্যে ইউক্রেন বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তখন যে পরিমাণ ভূমি ছাড় দিত, এখন তার চেয়ে বেশি ভূমি ছাড় দেবে। তবে এটি কিছু মৌলিক বিষয় অর্জন করবে : সার্বভৌমত্ব, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বন্দোবস্ত ও শান্তি।
২০২২ সালের আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল তা হলো ইউক্রেনের স্থায়ী নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। বিতর্কিত অঞ্চলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে, যার মধ্যে উভয় পক্ষ সীমান্ত পরিবর্তনের জন্য শক্তি ব্যবহারে বিরত থাকার অঙ্গীকার করেছিল। বর্তমান বাস্তবতায় ইউক্রেন ক্রিমিয়া এবং দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশ ছাড় দেবে, যেখানে গত তিন বছরের যুদ্ধে প্রাপ্ত ফলাফলের প্রতিফলন ঘটবে।
এমন একটি চুক্তি অবিলম্বে স্বাক্ষর হতে পারে। বস্তুত এটি সামনের মাসগুলোতে স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র আর যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না, ফলে ইউক্রেন আরও বেশি হতাহত ও ধ্বংসের সম্মুখীন হবে এবং ভূমি হারাবে। তাই জেলেনস্কি বুঝতে পারছেন, এখন আলোচনা করার সময় এসেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কংগ্রেসে তার ভাষণে জেলেনস্কির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘ইউক্রেন যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা টেবিলে আসতে প্রস্তুত, যাতে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়।’
২০২২ সালের এপ্রিলে স্থগিত বিষয়গুলো ছিল, ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার পুনঃনির্ধারিত সীমান্ত। গ্যারান্টির বিষয়ে প্রধান সমস্যা ছিল চুক্তির সহ-গ্যারান্টর হিসাবে রাশিয়ার ভূমিকা। ইউক্রেন জোর দিয়েছিল, পশ্চিমা সহ-গ্যারান্টরদের রাশিয়ার সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ছাড়া কাজ করতে সক্ষম হওয়া উচিত, যেন রাশিয়াকে ইউক্রেনের নিরাপত্তায় ভেটো ক্ষমতা দেওয়া না হয়। উভয় পক্ষেরই নিজস্ব যুক্তি ছিল।
আমার মতে, সেরা সমাধান হলো, নিরাপত্তা গ্যারান্টিগুলোকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্বের অধীনে রাখা। এর মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সহ-গ্যারান্টর হবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বাকি সদস্যদের সঙ্গে। এটি নিরাপত্তা গ্যারান্টিগুলোকে বিশ্বব্যাপী পর্যবেক্ষণের অধীনে আনবে। হ্যাঁ, রাশিয়া ইউক্রেনের বিষয়ে পরবর্তী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিতে পারে, কিন্তু যদি রাশিয়া জাতিসংঘের বাকি সদস্যদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অযাচিতভাবে এ কাজ করে, তাহলে চীনের অসন্তোষ এবং অন্যান্য দেশের ক্ষোভের সম্মুখীন হবে।
সীমান্তের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়ে কিছু পটভূমি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের হিংসাত্মক পতনের আগে রাশিয়া ইউক্রেনের কোনো ভূখণ্ড দাবি করেনি। ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনের জন্য নিরপেক্ষতা পছন্দ করতেন, ন্যাটো সদস্যপদের বিরোধিতা করতেন এবং সেভাস্তোপলে রাশিয়ার নৌঘাঁটির জন্য মস্কোর সঙ্গে ২০ বছরের লিজের বিষয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন, যা ১৭৮৩ সাল থেকে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর বহরের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ইয়ানুকোভিচের পতনের পর ইউক্রেনের যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ন্যাটোপন্থি সরকারের সময়ে রাশিয়া দ্রুত ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারে তৎপর হয়, যাতে নৌঘাঁটি ন্যাটোর হাতে না পড়ে। ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের অন্য কোনো ভূখণ্ড সংযুক্ত করার জন্য চাপ দেয়নি। রাশিয়া ইয়ানুকোভিচের পতনের পর তৎক্ষণাৎ কিয়েভ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পূর্ব ইউক্রেনের জাতিগত রুশ অঞ্চলের (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান জানিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ইউক্রেন দনবাসের স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাখ্যান করতে সমর্থন দিয়েছিল। জার্মানি ও ফ্রান্স এ সময় নীরব ছিল।
ছয় বছর পর মার্কিন অস্ত্রবাহী ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী দনবাসে গোলাবর্ষণ করতে থাকলে বিচ্ছিন্ন প্রদেশগুলোকে দমন ও পুনরুদ্ধার করার জন্য রাশিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ইস্তান্বুল প্রক্রিয়ায় দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের মর্যাদা চূড়ান্ত করার কথা ছিল। হয়তো তখন ইউক্রেনের দ্বারা এর বাস্তবায়ন (দুটি অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনকে ইউক্রেনের সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া) হলে বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হতে পারত। যখন ইউক্রেন আলোচনার টেবিল থেকে সরে আসে, দুর্ভাগ্যবশত বিষয়টি অর্থহীন হয়ে পড়ে। কয়েক মাস পর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ মস্কো ইউক্রেনের দুটি অঞ্চল খেরসন ও জাপোরিঝিয়া রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে।
এটিই হলো দুঃখজনক শিক্ষা। ইয়ানুকোভিচের হিংসাত্মক পতন না হলে ইউক্রেনের ভূখণ্ডের ক্ষতি সম্পূর্ণরূপে এড়ানো যেত এবং সেখানে মার্কিন সমর্থিত ন্যাটো সদস্যপদে আগ্রহী সরকারের উত্থান ঘটত না। পূর্ব ইউক্রেনে ভূখণ্ডের ক্ষতি তখন এড়ানো যেতে পারত, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সমর্থিত মিনস্ক-২ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিত। পূর্ব ইউক্রেনে ভূখণ্ডের ক্ষতি সম্ভবত ২০২২ সালের এপ্রিলে ইস্তান্বুল প্রক্রিয়ায় এড়ানো যেত, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র শান্তি চুক্তিতে বাধা দিয়েছিল। ইয়ানুকোভিচের পতনের ১১ বছর পর যুদ্ধে ক্ষতির ফলস্বরূপ ইউক্রেন ক্রিমিয়া এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের অন্য অঞ্চল পরবর্তী আলোচনায় ছেড়ে দেবে।
ইউরোপের আরও কিছু স্বার্থের বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত, বিশেষ করে বাল্টিক দেশগুলোর নিরাপত্তা এবং ইউরোপীয়-রুশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা। বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়ার ব্যাপারে নিজেদের খুবই অরক্ষিত বোধ করে, যা তাদের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়। কিন্তু তারা তাদের জাতিগত রুশ নাগরিকদের বিরুদ্ধে নেওয়া দমনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের অরক্ষিত অবস্থাকে গুরুতর এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাড়িয়ে তুলছে, যার মধ্যে রয়েছে রুশ ভাষা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং রুশ অর্থডক্স চার্চের সঙ্গে তাদের নাগরিকদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা। বাল্টিক দেশগুলোর নেতারা তীব্র রুশবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে উসকানি দিচ্ছেন। জাতিগত রুশরা এস্তোনিয়া ও লাতভিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ এবং লিথুয়ানিয়ার প্রায় ৫ শতাংশ। বাল্টিক দেশগুলোর নিরাপত্তা উভয় পক্ষের দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হওয়া উচিত, যার মধ্যে থাকবে জাতিগত রুশ জনগণের সংখ্যালঘু অধিকারকে সম্মান করা এবং বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা।
ইউরোপ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার জন্য সম্মিলিত নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে। ইউরোপকে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করা উচিত এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনকে ২০২২-এর ২৯ মার্চের ইস্তান্বুল কমিউনিক এবং ১৫ এপ্রিলের প্রস্তাবিত চুক্তির ভিত্তিতে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য আহ্বান জানানো উচিত। ইউক্রেনে শান্তির পর ইউরোপের সব অঞ্চলে একটি নতুন সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা ব্রিটেন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত এবং এর বাইরেও সম্প্রসারিত হবে।
কমোন ড্রিমস থেকে অনূদিত
জেফ্রি ডি. স্যাশ : যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক