Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মিঠে কড়া সংলাপ

আসন্ন নির্বাচনি যুদ্ধে পাল্লা ভারী কোনদিকে

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আসন্ন নির্বাচনি যুদ্ধে পাল্লা ভারী কোনদিকে

ফাইল ছবি

সব দিক বিচার-বিশ্লেষণ এবং হিসাব-নিকাশ করে মনে হচ্ছে, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং এ নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী সেই দল তিনটি হতে পারে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং সদ্য গঠিত এনসিপি। এই দল তিনটির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হলো জামায়াতে ইসলামী এবং তারপর বিএনপি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করার পর ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করার পর নানা সংকটের মধ্যে একসময় বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয় এবং অতঃপর তিনি আবার বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এ অবস্থায় ৪৭ বছরের পুরোনো দল বিএনপি কয়েক দফা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দীর্ঘ ১৯ বছর একটানা ক্ষমতার বাইরে থেকে আবারও নির্বাচনি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে চলেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির চেয়ে পুরোনো একটি রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও কোনদিনই দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি।

বর্তমান অবস্থায় বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি এবং দলটি শক্তিশালী বিবেচিত হলেও শক্তিমত্তার দিক থেকে জামায়াতে ইসলামীকেও কম কিছু মনে হচ্ছে না। কারণ মাঠে-ঘাটে চারদিকে তাকালেই তাদের লোকজনকে মিটিং-মিছিলে সরব দেখা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা তাদের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন করে চলেছে এবং তাদের সে শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বতর্মান অবস্থায় দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। কারণ একটানা ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রেখে ক্ষমতাসীনদের প্রায় সবাই আখের গুছিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আর এসব ঘটনাও জামায়াতে ইসলামী দলটির জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দিয়েছে। কারণ আওয়ামী শাসনামলে তারা কোনোদিন দেশের কোথায়ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় জামায়াতের লোকজন প্রাণভরে স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারায় দলীয় নেতাকর্মীরাও ভীষণ উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। একশ্রেণির ধর্মপ্রাণ মুসলমান বা ধর্মভীরু মানুষকে জামায়াতের অনুসারী বলেই মনে হয়। আর সেসব মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সুতরাং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী দলটি যে একটি হেভিওয়েট শক্তি হিসাবেই আবির্ভূত হতে চলেছে, সে কথাটি এখানে উল্লেখ না করলেও চলে। তাছাড়া জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে ভিন্নতর। তাদের নেতাকর্মীদের নৈতিক ভিত্তি অনেকাংশে মজবুত। অন্য আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতাকর্মীদের মতো তাদের গায়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গোছের অপকর্মের লেবেল আঁটা নেই। অন্যান্য দলের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী এদেশে কিছুটা হলেও ক্লিন ইমেজের দাবিদার। সুতরাং এবারের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী দলটিকে নির্বাচনি ময়দানে গুরুত্ব দিয়েই অন্যান্য দল, হোক সে বিএনপির মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, তাদেরকেও পাকাপোক্তভাবে নিজ নিজ স্ট্র্যাটেজি সাজাতে হবে। বিশেষ করে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলটিকে আরও ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করে শক্তিশালীভাবে নির্বাচনি ময়দানে আবির্ভূত হতে হবে। এক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনসহ দলের নেতাকর্মীদের জনগণের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। এখনই ক্ষমতায় এসে গেছি এমন ধারণা পোষণ করে দলের কোনো নেতাকর্মী যদি দেশের মানুষের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করে বসেন, যাতে করে জনসাধারণ নিজেদেরকে অনিরাপদ মনে করেন বা কোনো কোনো নেতাকর্মী তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য চাঁদাবাজিসহ সমাজবিরাধী কোনো কাজকর্ম বা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়েন, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের সময় কিন্তু দলটিকে খেসারত দিতে হবে। আর সেই কারণেই বোধহয় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার এসব বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলেছেন।

জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই ৬/৭ মাসে যতটা অগ্রসর হয়েছে, তাতে করে অন্য কোনো দল বা শরিক যদি তাদের সঙ্গে জোট বাঁধে, তাহলে আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষেও চলে যেতে পারে। যদিও বিষয়টি নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ধারণা।

এ বিষয়ে এখানে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত এনসিপি দলটি সম্পর্কেও কিছু বলা সমীচীন বলে মনে করছি। কারণ জুলাই বিপ্লবের বিজয়ী ছাত্র-জনতার বিপ্লবী আবেগ নিয়েই দলটি গঠিত হয়েছে। আর যে তরুণ সমাজ দলটির হাল ধরেছেন, তারাও আসন্ন নির্বাচনে একটি ভালো ফলাফলের আশা করছেন বলেই মনে হয়। সে ক্ষেত্রে এনসিপি যদি নির্বাচনে ভালো করতে পারে, তাহলে তারাও ক্ষমতার লড়াইয়ে নিজেদেরকে সুবিধাজনক অবস্থায় তুলে ধরতে পারবেন। এ অবস্থায় এনসিপির পক্ষে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব যদি নাও হয়, তারপরও তারা নিজেদেরকে শক্তিশালী অবস্থানে রেখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে অন্য যে কোনো দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে এনসিপির পক্ষে এককভাবে ক্ষমতায় যেতে না পারার কথা বলার কারণ হলো, দলটি নতুন এবং তৃণমূল পর্যায়ে তাদের তেমন কোনো শক্তিশালী সংগঠন নেই। তবুও তারা জুলাই বিপ্লবের আবেগের ওপর ভর করে এবং নিজেদের ন্যায়নিষ্ঠতা, দেশপ্রেমে তাদের উজ্জ্বল ভূমিকা, স্মৃতি জাগানিয়া জুলাই বিপ্লবের শক্তি বুকে ধারণ করে নির্বাচনি ময়দানে অবতীর্ণ হলে দেশের মানুষ তাদেরকে নিরাশ করবেন বলে মনে হয় না। দেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার তাদের পাশে থাকবেন, এ কথাটি মনে করা মনে হয় ভুল হবে না।

এ অবস্থায় এবারের নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ যে একটু অন্যরকম হবে, সে কথাটিই এখানে বলার চেষ্টা করা হলো। কারণ একদিকে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর অগ্রযাত্রা, অন্যদিকে নতুন দল হিসাবে এনসিপির বাজিমাত করার সম্ভাবনা-এ দুটি ঘটনা একত্র করেই এবারের নির্বাচনের সমীকরণটি মেলান উচিত বলে মনে করছি।

আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারা না পারার বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বারবার দলীয় নেতাকর্মীদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, আমার লেখায় আমিও সেই কথাটিই বলতে চেয়েছি। এখন বিএনপির বন্ধুরা তা বুঝলেই হলো! এ বিষয়ে সবশেষে আমি যা বলতে চাই তা হলো, বিএনপির নেতাকর্মীরা যদি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনোরূপ অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ না আসে, কেবল তখনই আসন্ন নির্বাচনে তাদের দল বিজয়ের মুকুট মাথায় পরতে পারবে; আর এজন্য সামনের দিনগুলোতে অবশ্যই তাদের প্রয়োজনীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে; তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়, দুর্নীতি ইত্যাদি অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে দেশ ও জাতি তাদেরও কিন্তু ক্ষমা করবেন না।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম