শতফুল ফুটতে দাও
আর দেরি নয়, প্রতিরোধ এখনই

প্রতীকী ছবি
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। এসব ঘটনা থেকে একটি কথাই বলা যায়, আর তা হলো এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটার মূলে রয়েছে অসুস্থ সমাজ এবং অপরাধীদের বিকৃত মানসিকতা। ১১ মার্চ মঙ্গলবার একটি দৈনিকের উপ-শিরোনাম ছিল, ‘রাজধানীর গুলশান, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, কুমিল্লা, ফেনী, শেরপুর, লক্ষ্মীপুর ও বগুড়ায় ৮ শিশু-কিশোরীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ ওঠে’। সাম্প্রতিক সময়ে দেশবাসীকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে মাগুরার ৮ বছরের একটি শিশুর তার নিকটজনের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা। দুর্ভাগ্য এ মেয়েটিকে সিএমএইচে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। গত সোমবার সকালে প্রথমবারের মতো মেয়েটির চোখের পাতা নড়েছে। তবে তার শারীরিক অবস্থার খুব সামান্যই উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে শিশুটির স্বাস্থ্যের এ অবস্থার কথা জানানো হয়েছে।
বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ৮ বছরের শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার মা। শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাসুরকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। শিশু বোনের শ্বশুরকে ৭ দিন, স্বামী, শাশুড়ি ও ভাসুর প্রত্যেকের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। হায়! সমাজ আজ কত অধঃপতিত যে একটি ৮ বছরের শিশু তার বোনের বাড়িতে নিরাপদ নয়! যারা আত্মীয়-স্বজন বা মুরব্বির পর্যায়ে পড়ে, তারা হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অবোধ শিশুটির ওপর। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, এই নরপশুরা যেন ছাড় না পায় এবং সর্বোচ্চ শাস্তিতে দণ্ডিত হয়। যাতে দেশ ও জাতির সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুতফা মনে করেন, নারীদের ঘরে ঢোকাতে চাইছে একটি গোষ্ঠী। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজে নানা কিসিমের শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে। একথা সত্য যে, এই অভ্যুত্থান অতীতের যে কোনো অভ্যুত্থানের তুলনায় ভীষণ প্রবল ও গণবিরোধী শক্তির সংহারি হয়ে উঠেছিল। এ অভ্যুত্থানের সুযোগে এমন কিছু তমসাবাদী শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে, যারা নারীকে সমাজে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে দেওয়ার বিরোধী। প্রত্যেক সমাজেই ভালো-মন্দের শক্তিগুলো পাশাপাশি বিরাজ করে। যে সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুঠাম ও শক্তিশালী, সেখানে মন্দের শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের এক অধ্যাপক শ্রেণিকক্ষে লেকচার দেওয়ার সময় বলেছিলেন, মানুষ কেন দৈনন্দিন জীবনে যথেচ্ছাচার করতে পারে না। কেন জৈবিক তাড়না থাকা সত্ত্বেও যখন-তখন ধর্ষণের মতো দুরাচার করতে পারে না। এর ব্যাখ্যা হলো সমাজ তার বিধি-বিধান, আচার-আচরণ ও নৈতিকতার শক্তিতে প্রতিটি মানুষের ভেতরকার জৈবিক তাড়নাকে দমনে রাখে। এর ফলে সমাজে কোনো নেতিবাচক প্রবণতা সার্বিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না।
বাংলাদেশের সমাজে নারীরা বেশকিছু দূর এগিয়ে গেছে। এখানে নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়েছে, শিক্ষকতা, আইন পেশা ও চিকিৎসা পেশাসহ নানা পেশায় নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছে। এমনকি সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতেও নারীদের রয়েছে সাহসী পদচারণা। সমাজের একটি কূপমণ্ডূক গোষ্ঠী নিজেদের জ্ঞানের অভাব ও সংকীর্ণ চিন্তার বশবর্তী হয়ে নারীদের এ জাগরণকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে চাইছে। দেশে এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এ স্বাধীনতার সুযোগ তমসাবাদী শক্তিগুলোও গ্রহণ করছে। যেহেতু আমাদের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সমাজ এখনো থিতু হয়নি, সেহেতু সমাজের নেতিবাচক শক্তিগুলো নানাভাবে সমাজকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বেশ তৎপর। ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ যেসব মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেগুলো কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে দেশের পুলিশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থানজনিত ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এ কারণে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভয়ানকভাবে দোদুল্যমান। এর সুযোগ গ্রহণ করছে অপরাধীরা এবং মনোবৈকল্যে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। সরকার পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স সংযোজিত করার চিন্তা করছে। এর ফলে কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ যাদের অক্সিলারি ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাদের চারিত্রিক ও আচরণগত শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, নিপীড়ক, নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠী প্রশ্রয় পেয়েছে। প্রশ্ন হলো, ব্যাপারটি কি প্রশ্নজনিত, না পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণজনিত! তিনি মনে করেন, সমাজে আধিপত্য ও বৈষম্যবাদী ব্যবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশক নারীর ওপর নির্যাতন। তার এ মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে নারীর অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ। দেওয়ালের গ্রাফিতিতে শ্রেণিবৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসন, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ছিল খুবই শক্তিশালীভাবে। কিন্তু বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এসব আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সরকার এবং সরকারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের কথা ও কাজে শক্তিশালীভাবে পাওয়া যায়নি। কখনো কখনো বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে। এটা একটা বড় উদ্বেগের কারণ।’
নিঃসন্দেহে এটা উদ্বেগের কারণ। ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গেলে দৃশ্যমানতা (Appearance) ও বাস্তবতার (Reality) মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলো বিধ্বস্ত! দালান কোঠা বিধ্বস্ত হয়নি, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায় গাজার মতো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এ বিধ্বস্ত পরিস্থিতি অতিক্রম না করে সুষ্ঠু, সুন্দর কিছু আশা করব কী করে? প্রফেসর আনু মুহাম্মদ একজন মার্কসবাদী। তিনি তো জানেন সোভিয়েত রাশিয়াতে অক্টোবর বিপ্লবের পর কী হয়েছিল। খোদ লেনিন বলেছেন, Never was the condition of the proletariat was so bad as under the dictatorship of the proletariat. তখন তো সর্বহারাদের বিপ্লবী ভ্যানগার্ড পার্টি বলশেভিক পার্টি ছিল। এ পার্টি ছিল আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত মজবুত। তা সত্ত্বেও বিপ্লব-পরবর্তী কয়েক বছর সামাজিক দুরবস্থা দূর তো করা যায়নি বরং আরও প্রবল হয়েছে। বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় এর নেতৃত্বে কোনো ভ্যানগার্ড পার্টি ছিল না। হ্যাঁ, বেশ কিছু তরুণ ছিল, যারা পাঠ্যচক্রের মাধ্যমে এক ধরনের চিন্তায় বলীয়ান হয়ে উঠেছিল। তবে এ শক্তির পক্ষে একটি বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া ও বিপ্লবোত্তরকালে সমাজকে গুছিয়ে তোলা এবং জরাজীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জায়গায় নতুন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ বাস্তবতাকে কী বলবেন?
অধ্যাপক সামিনা লুতফা বলেছেন, ‘প্রতিটি যৌন নিপীড়ন, সন্ত্রাসের ঘটনার বিচার হতে হবে। কোনো একটি ঘটনাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এসব নিপীড়ন ও অপরাধ বন্ধ করতে হবে। পতিত আওয়ামী লীগ ক্রমাগত বোঝাতে চাইছে যে, তারা না থাকলে বাংলাদেশ নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য অনিরাপদ হয়ে যায়। এ বয়ান তৈরি করার জন্য এসব বিষয়কে অনেক বেশি সামনে আনা হচ্ছে বলে মনে করার অবকাশ আছে। প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, একদল এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, যেন ৫ আগস্টের আগে এমন অপরাধ হতো না! এ বয়ান তৈরির বিষয়েও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। খুবই হক কথা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনামলে নারীরা কতটা নিরাপদ ছিল? মঙ্গলবার একটি দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, ‘পতিত স্বৈরাচার সরকারের সামনে ছাত্রাবাস থেকে শুরু করে রাজপথে কোথাও বাকি ছিল না ধর্ষণের মচ্ছব! শেষ ৬ বছরেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ হাজার শিশুসহ প্রায় ৪৩ হাজারের বেশি নারী। এ সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার নারী। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৮ নারী ও শিশু। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী দ্বারা নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু নারীবাদী নেত্রী এবং মহিলা পরিষদসহ এমন ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদ দূরের কথা, বিভিন্ন সংগঠনের উদ্বেগ ধামাচাপা দিয়েছে বছরের পর বছর। এ সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতার নিন্দা করতে গিয়ে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে আওয়ামী আমলে নারী নির্যাতনের ঘটনা কোনো অংশে কম ছিল না। সুতরাং আমাদের নিন্দার বর্শাফলক নিক্ষিপ্ত হতে হবে রাজনৈতিক আমল নির্বিশেষে। অন্যথায় নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন সম্ভব হবে না।
এই কলামে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণেরও একটি মাপকাঠি থাকা দরকার। পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ আমাদের এ প্রাচ্য সমাজে প্রচলন কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশ্বায়নের প্রভাবে এর প্রতিরোধ অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও সমাজচিন্তকদের ভাবতে হবে আমাদের সামাজিক নৈতিকতার স্বরূপ কী হবে। নারীকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্যে পরিণতকরণও আমাদের দুর্যোগ, দুরবস্থার শিকারে পরিণত করেছে। তবে এ মুহূর্তে শেষ কথা, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হবে এখনই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ