Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নতুন রাজনৈতিক দল : কিছু পরামর্শ

Icon

জিয়া আহমদ

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন রাজনৈতিক দল : কিছু পরামর্শ

ছবি: সংগৃহীত

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির’ উদ্যোগে এবং নানা মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে একটি নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এ নতুন দলটির আবির্ভাব বহু প্রত্যাশিত ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি প্রকাশ্য অনাস্থা এবং তাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর কথিত নিস্পৃহতার কারণে।

গত ৫ আগস্টের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতৃত্বের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে অবজ্ঞা ও তাদের অবদানকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রথম বিভক্তির সূচনা হয়। অবশ্য এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি ঘটাই যে নিয়তি ছিল, তা বলা চলে। কারণ, গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের স্বাধীনতাসহ সব অর্জনকে একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ করার ইতিহাস আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘উইনার টেকস অল’ বিষয়টি প্রায় প্রতিষ্ঠিতই বলা যায়। সে কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের আলাদাভাবে দোষারোপ করার সুযোগ খুবই কম। যা হোক, এ নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি প্রতীক্ষার অবসান হলো। একইসঙ্গে একটি দলীয় কাঠামোর মধ্যে আসার কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা তাদের বক্তব্যের ক্ষেত্রে এখন থেকে অনেক হিসাবি হবেন, এটা প্রত্যাশা করাই যায়।

একটি রাজনৈতিক দলের মূল উদ্দেশ্য কী? এক কথায় বলতে গেলে, ক্ষমতায় যাওয়া। এ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক দলকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। প্রথমত, দেশের জনগণের সামনে একটি রাজনীতি উপস্থাপন করতে হয়, যা জনগণ গ্রহণ করবে বলে তারা মনে করে। অর্থাৎ, কোনো রাজনৈতিক দলের ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ওই রাজনৈতিক মতাদর্শ বাস্তবায়নের প্রস্তাবিত পথ জনগণের চাওয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে দেশের জনগণ তা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত, একটি রাজনৈতিক দলের এমন একজন নেতা নির্ধারণ করতে হয়, যাকে দেশের মানুষ আস্থায় নেয়। দলনেতার জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, দক্ষতা, সর্বোপরি তার অতীত কার্যক্রম দলের ঘোষিত রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উপযোগী কিনা এবং দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেতার আছে কিনা, দেশের জনগণ সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। এক্ষেত্রে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক দলের জন্য ‘অতিরিক্ত’ পাওয়া হিসাবে বিবেচিত হয়। অবশেষে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তার ঘোষিত রাজনীতির বাস্তবায়নই একটি রাজনৈতিক দলের মূল চিন্তাভাবনা বা লক্ষ্য।

নবগঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নিয়ে বেশকিছু কথা গণমাধ্যমে এসেছে। এ নতুন দলের মূল নেতৃত্ব ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে এলেও এ দুই সংগঠনের কোনো কোনো গ্রুপ নতুন দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই সভাপতির বাদ যাওয়াটা অনেকের চোখে লেগেছে। তারপরও নতুন এ দলে সাবেক বামপন্থি থেকে সাবেক ডানপন্থিদের অবস্থান রয়েছে। দলের আহ্বায়ক ঘোষণা করেছেন, এ দলটি রাজনীতির ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অনুসরণ করবে। সেক্ষেত্রে দলে থাকা দুই বিপরীত মেরুর নেতাকর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কীভাবে সমন্বিত ও বাস্তবায়িত হবে, তা এখন দেখার বিষয়।

সদ্য আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ বা এনসিপি সব দিক দিয়েই নবীন। তাদের রাজনীতি এখনো স্থির হয়নি। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, তারা এ বিষয়ে এখন কাজ করছেন। তবে তারা আত্মপ্রকাশের ক্ষণেই তাদের ইচ্ছা বা প্রত্যাশার কিছু আভাস দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এদেশে ‘ভারতপন্থি’ বা ‘পাকিস্তানপন্থি’ কোনো দল রাজনীতি করতে পারবে না। ভালো প্রস্তাব। কিন্তু একইসঙ্গে তারা দেশের গণমানুষের প্রত্যাশার বাইরেও কিছু দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, তারা ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং দেশের সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য ‘গণপরিষদের’ নির্বাচন চান।

এ দাবি দুটি খুব পুরোনোও নয়; আবার একদম যে নতুন, তা-ও না। গত ২০২৪ সালের শেষভাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ ঘোষণা ও বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবি তোলা হলেও দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলো সে দাবিকে আমলে নেয়নি; বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বিষয়টিকে সমর্থন না করার কারণে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। অন্যদিকে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ইতঃপূর্বে ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করে, যার প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে অধ্যাপক আলী রিয়াজের সহ-নেতৃত্বে গঠিত ‘ঐকমত্য কমিশন’ ইতঃপূর্বে দাখিলকৃত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর বিষয়ে একটি ‘ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য ‘গণপরিষদ’ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন যৌক্তিক হলো কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

দল হিসাবে আত্মপ্রকাশের আগে এ দলের নেতাদের অনেকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এখন যেহেতু তারা একটি দলের ব্যানারে রয়েছেন, তাই তাদের একই সুরে কথা বলতে হবে। দলের প্ল্যাটফর্মে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের বলতে হবে তারা প্রকৃতপক্ষে কী চান। একইসঙ্গে তাদের বুঝতে হবে, দলের জন্য যা মঙ্গলজনক বিষয়, তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে। আর নিজেদের দলীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বৈরাচারী আচরণ প্রদর্শন করাকে পরিহার করতে হবে। আরও একটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার, সেটি হলো এখনো দুজন ছাত্র-সমন্বয়ক সরকারে আছেন। তারা অবশ্যই নতুন দলে যোগ দেবেন। কিন্তু এখনো সরকারে থেকে তারা কী অর্জন করতে চাচ্ছেন, তা দেশের জনগণকে পরিষ্কারভাবে জানানো প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে বিলম্ব অনেক সময়েই হিতে বিপরীত হয়।

নতুন দল গঠনের বিষয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি সহায়তা গ্রহণের বিষয়টি। অভিযোগ রয়েছে, অনেক জেলা থেকে এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাস রিকুইজিশন করা হয়েছে। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা তুলেছেন। নতুন সংগঠন গঠনের প্রারম্ভিক সময়ে এ ধরনের কিছু অনিয়ম হতে পারে, কিন্তু এর পুনরাবৃত্তি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাছাড়া নতুন দলের প্রতিষ্ঠাকালে যে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ কথা বলা হয়েছে, এ ধরনের কার্যক্রম তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

একটি বিষয় অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার, আর তা হলো নতুন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ। জাতীয় নাগরিক পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা নাহিদ ইসলামের এ পদক্ষেপ তাকে আরও জনপ্রিয় করবে, সন্দেহ নেই। তবে দলের অন্য যেসব নেতার অর্থসম্পদের বিষয়ে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, তারও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট নেতা তো বটেই, দলের তরফ থেকেও দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ প্রশ্নটা প্রথমেই মুখথুবড়ে পড়তে পারে।

নতুন দলের নেতৃত্বকে স্মরণে রাখতে হবে, এ মুহূর্তে দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যে স্বৈরাচারকে উৎখাত করা হয়েছে, তার বড় একটা সুবিধাভোগী সমর্থকগোষ্ঠী এখনো দেশে রয়েছে। আপাদমস্তক অনুশোচনাহীন ও নির্লজ্জ এ সুবিধাভোগীরা বিপুল অর্থসম্পদের মালিক। বর্তমানে বিরূপ পরিস্থিতিতে তারা গা-ঢাকা দিয়ে ‘চোরাগোপ্তা’ আন্দোলন করলেও সামনের নির্বাচনের সময়ে তারা আগ্রাসি হয়ে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে নিজ স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসবে, যার মাধ্যমে জুলাই গণ-অভুত্থানের অর্জনগুলো ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সে কারণে এ নতুন দলের নেতৃত্বকে গণ-অভ্যুত্থানের অপরাপর অংশী-রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ন্যূনতম কিছু ইস্যুতে ঐকমত্যে আসতে হবে, যাতে স্বৈরাচারের ফিরে আসার পথটা কোনোমতেই উন্মুক্ত না হয়ে পড়ে। আর কোনো শর্টকাট পথে বা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণের প্রলোভনকেও জয় করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের যে কোনো প্রস্তাবই ফাঁদ এবং সে ফাঁদে একবার পা দিলে তাদের সব অর্জন ধুলায় মিশে যেতে সময় লাগবে না।

নতুন দল সংগঠন করা একটি দুরূহ কাজ। আমাদের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নায়করা এ কঠিন কাজে হাত দিয়েছেন। তাদের এখন অনেক বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে। দল সংগঠনের নামে অনেক ধান্দাবাজ লোকজন দলে ভিড়ে ব্যক্তিস্বার্থে নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর লক্ষণ ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র অফিসে সংঘটিত নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে। আর চাঁদাবাজি তো আজকাল আমাদের জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত নেতারা এখন পর্যন্ত চাঁদাবাজদের বিষয়ে কঠোর মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন। নতুন দলের কাছেও একই প্রত্যাশা থাকবে। কোনো ব্যক্তিই, তা তিনি দলে যত গুরুত্বপূর্ণই হোন না কেন, দলের চেয়ে বড় নন-এটা নতুন দলের কাণ্ডারিদের মনে রাখতে হবে এবং এ বিষয়গুলোতে দলের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করে দেবে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ দেশের রাজনীতির অঙ্গনে বড় ফ্যাক্টর হিসাবে আবির্ভূত হবে নাকি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘ফুট নোটে’ জায়গা পাবে।

জিয়া আহমদ, এনডিসি : সাবেক সরকারি কর্মচারী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম