চাই বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতা

ফাইল ছবি
‘বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতা’ কথাটি খুবই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ওপেন (open) সোসাইটি বা মুক্ত সমাজ বলতে তাকেই বুঝি, যেখানে সব ধরনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। আর ক্লোজড (closed) সোসাইটি বা বদ্ধ সমাজ হচ্ছে সেই সমাজব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকদের স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার থাকে না। ইচ্ছা করলেই একজন নাগরিক তার স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে না। উন্নত ও উদার গণতান্ত্রিক সমাজে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। একটি রাষ্ট্র যতটা উন্নত ও গণতান্ত্রিক হবে, সেখানে নাগরিকদের চিন্তার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ততই নিশ্চিত হবে। ফরাসি দার্শনিক রুশো তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Social Contract’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘Man is born free but everywhere he is in chain’, অর্থাৎ একজন মানুষ স্বাধীনভাবেই জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে সে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। কারণ যুগে যুগে মানব ইতিহাসে দেখা গেছে অধিকার হরণের কাহিনি। বাস্তবে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তিকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। চিন্তা করা বা নিজস্ব মতামত প্রকাশের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের জন্মগত অধিকার। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এ সুবিধা বা অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ব্যত্যয় ঘটে। আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা থাকবে এবং রাষ্ট্র সে স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। একটি সমাজে বিভিন্ন মত থাকতে পারে। সবাইকে তাদের নিজ নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। কোনোভাবেই একজন নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করা যাবে না। এমনকি সরকারবিরোধী মতামতও প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার পরিবেশ না থাকলে একটি রাষ্ট্র কখনোই সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না।
একজন যে আদর্শ লালন করেন, তা অন্য কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাই বলে তার অভিমত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই হরণ বা খর্ব করা যাবে না। কাউকে তার মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া যাবে না। আবার যারা মতপ্রকাশ করবেন তাদেরও মনে রাখতে হবে, তার প্রকাশিত কোনো মত বা চিন্তা যেন রাষ্ট্রের ক্ষতি না করে, জাতির অমঙ্গল ডেকে না আনে। অর্থাৎ মতপ্রকাশ এবং চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য হচ্ছে সেখানে সবার মতামত প্রকাশের অধিকার এবং চিন্তার স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই মতপ্রকাশ এবং চিন্তার স্বাধীনতা নেই। অথবা থাকলেও তা সীমিত পরিসরে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। পৃথিবী যতই উন্নতির দিকে যাচ্ছে, মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতার গুরুত্ব ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু অনেক দেশেই শাসক শ্রেণি তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখার জন্য নানাভাবে নাগরিকদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে থাকে। এমনকি কোনো কোনো দেশে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করাকে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ হিসাবেও গণ্য করা হয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ প্রবণতা বেশি প্রত্যক্ষ করা যায়। এসব দেশের শাসক শ্রেণি সব সময় চায় নাগরিকরা তাদের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করবে। তারা যে কাজ করবে, তা যত ভালো বা মন্দ যাই হোক, নাগরিকরা তা সমর্থন করবে। এই শ্রেণির শাসকগোষ্ঠী চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে ভালোবাসে। তারা মনে করেন, তাদের কোনো ভুল হতে পারে না। তাদের ভাবখানা এ রকম, ‘কিং ইজ অলওয়েজ রাইট।’ অর্থাৎ রাজা বা শাসক কখনোই ভুল করতে পারেন না। এ শ্রেণির শাসক ভিন্নমত সহ্য করতে পারেন না। তারা নিজেদের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চান।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বুদ্ধির মুক্তি এবং চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, কারও মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ভিন্নমত যত তিক্তই হোক না কেন, তা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না। এমনকি একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীরও যদি নিজস্ব কোনো মত বা আদর্শ থাকে, তা প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।
বর্তমান যুগ হচ্ছে গণতন্ত্রের যুগ। আর গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্যই হচ্ছে সবার স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক সমাজে বহু মত থাকবে। এখানে শত ফুল ফুটবে। সৌন্দর্য বিকাশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ফুলের স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করা হলে যেমন পরিবেশ সুবাসিত হতে পারে না, তেমনি কোনো সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা এবং নির্ভয়ে মতপ্রকাশের অধিকার না থাকলে সে সমাজকে কোনোভাবেই আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা বিকশিত হতে পারে না। আর আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার্জন করছেন, একদিন তারাই দেশের কর্ণধার হবেন। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ এবং ভিন্নমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মতো মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্নমত প্রকাশের তেমন কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে অসহিষ্ণু সরকারসমর্থিত ছাত্র সংগঠনের মাঝে ভিন্নমতের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অন্য রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। সেখানে জ্ঞানচর্চা হয়। বিশ্বের যত আধুনিক জ্ঞান তা আহরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিয়তই জ্ঞানচর্চার মধ্যে থাকতে হয়। আর যারা শিক্ষার্থী, তাদেরও অব্যাহতভাবে জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত থাকতে হয়। কিন্তু কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনের স্বৈরাচারী আচরণের কারণে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো জ্ঞানচর্চা করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। সে জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু সেজন্য তো উপযোগী ও অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু সেই অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে।
আমরা যদি দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য জ্ঞান আহরণের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকরা গবেষণার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করেন, তা কারও কাছে পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে সে জ্ঞান অর্জন ও তা বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। নদীর প্রবাহমুখে বাঁধ দিলে যেমন স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বিঘ্নিত হয়, ঠিক তেমনি জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে বাধ্য। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধ জ্ঞানচর্চার সুযোগ ও পরিবেশ নেই, সেটা সত্যিকারার্থে আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে বদ্ধ জলাশয় বলাই শ্রেয়।
আমরা যারা মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী, তারা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ সবসময়ই চেয়েছি, যেখানে জ্ঞানের উন্মুক্ত চর্চা হবে। একই সঙ্গে চলবে ভিন্নমতের অবাধ চর্চা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে একজন শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে। যে কোনো ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবে। এজন্য তাকে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হবে না। বুদ্ধিদীপ্ত মানসের প্রকাশ সম্ভব না হলে বুদ্ধির মুক্তি হবে না। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধ জ্ঞানচর্চা এবং নিজস্ব মতামত প্রকাশের অবারিত সুযোগ রয়েছে। আমরা বাংলাদেশেও তেমন সুযোগ চাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই স্বাধীন চিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারিনি। ভিন্নমতকে দলন এবং চিন্তার স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি বিবেচনা করি, তাহলে কী দেখব? বিগত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক কি স্বাধীনভাবে তার ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পেরেছেন? ভিন্নমত প্রকাশের কারণে শিক্ষককে এমনকি চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে। কাউকেবা হয়রানি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বাধীন মতপ্রকাশের দুয়ার কার্যত রুদ্ধ ছিল। সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বাইরে কথা বললেই যে কোনো শিক্ষক বা ছাত্রকে হয়রানি করা হতো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ফেসবুক স্ট্যাটাসে সরকারের সমালোচনা করায় তাকে সাইবার ক্রাইম অ্যাক্টের মাধ্যমে আটক করে কয়েক বছর কারাগারে বন্দি রাখা হয়। আরও শত শত ঘটনা আছে, যেখানে একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী সরকারের সমালোচনা করার কারণে নির্যাতিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমাদের মতো দেশে সবসময়ই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানাভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তা সবচেয়ে বেশি রুদ্ধ হয় স্বৈরাচারী সরকারের আমলে। স্বাধীন মতামত প্রকাশের কারণে যদি হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হতে হয়, সে সমাজে কখনোই মুক্ত বুদ্ধির চর্চা বিকশিত হতে পারে না।
গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মুখে স্বৈরাচারী শাসকের পতন হয়েছে। বর্তমান উন্মুক্ত পরিবেশে মুক্ত চিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে বলে আমরা আশাবাদী। বুদ্ধির মুক্তি এবং চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গেলে একটি উন্নত মানবিক সমাজ গঠন করা সম্ভব হতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের সমাজে এখন জ্ঞানের কদর নেই বললেই চলে। এখন জ্ঞানের চেয়ে অর্থবিত্তের মালিকদের কদর বেশি। তারাই সমাজের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে আছে। আমাদের সমাজে জ্ঞানী মানুষের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। তারা নানাভাবে অবহেলিত হচ্ছেন। যারা পদলেহনকারী-চাটুকার, তাদের মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু জ্ঞানী মানুষগুলো সর্বত্রই অবহলিত ও বঞ্চিত হচ্ছে।
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক মহামতি সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘Knowledge is virtue’ অর্থাৎ জ্ঞানই সদগুণ। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘Know thyself’। তখনকার গ্রিক সমাজ ছিল জ্ঞানবিমুখ। তারা সক্রেটিসকে সহ্য করতে পারেনি। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি যুবসমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। এতে যুবসমাজ বিপথে চলে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে সক্রেটিসকে হেমলক বিষপানে হত্যা করা হয়। সক্রেটিসের একমাত্র অপরাধ ছিল, তিনি মানুষের মাঝে আধুনিক জ্ঞানের কথা বলতে চেয়েছিলেন, তথা জ্ঞান প্রচার করতে চেয়েছিলেন। যে সম্রাট সক্রেটিসকে বিষপানে হত্যা করেছিলেন, সে সম্রাটকে পৃথিবী মনে রাখেনি। পৃথিবী মনে রেখেছে সক্রেটিসকে। এটাই বাস্তবতা বা নিয়তি। সক্রেটিস জ্ঞানকে আইভরি টাওয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকাশ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন।
সক্রেটিসের প্রিয় ছাত্র প্লেটো দার্শনিক রাজার (Philosopher King) শাসন কায়েমের কথা বলেছিলেন। কারণ তিনি সক্রেটিসের মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি। তার বক্তব্য ছিল, সম্রাট তথা শাসক হতে হবে এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি আদর্শিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবেন। এখানে দার্শনিক শব্দটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্লেটো দার্শনিক সম্রাট বলতে জ্ঞানী শাসককে বুঝিয়েছেন। প্লেটো তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি রিপাবলিক’-এ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, কেন সক্রেটিসের মতো একজন জ্ঞানী মানুষকে বিষপানে হত্যা করা হলো। প্লেটো বলেছেন, যে সমাজ জ্ঞানের কদর করে না, জ্ঞানী মানুষকে সহ্য করতে পারে না, তিনি তেমন সমাজ চান না। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষই জ্ঞানী হন, উদার হন। কাজেই শাসক যদি জ্ঞানী ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক হন, তাহলে সেই সমাজ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। যে দেশে শাসক শিক্ষিত এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত, সে সমাজে সাধারণত গণতন্ত্র হরণ হয় না। যেসব দেশের শাসক মূর্খ ও অশিক্ষিত, সেখানে মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে না।
আমরা চাই, বর্তমানে দেশে যে উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে আগামীতে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলা হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। সেটি সম্ভব হবে বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচাযর্, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত