Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা সমাজ দেশ

এসব স্বাভাবিক রাজনীতি নয়

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এসব স্বাভাবিক রাজনীতি নয়

ফাইল ছবি

আমি যে এদেশের নেহাত একজন শাশ্বত মাস্টার সাহেব, এ পরিচয় ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন। ক্লাসে বিভিন্ন বিষয় আমাকে পড়াতে হয়। এর মধ্যে বিজনেস এথিক্স, প্রফেশনাল এথিক্স, বিভিন্ন পেশার কোড অব কন্ডাক্ট ইত্যাদিও রয়েছে। প্রতিটি পেশার কোড অব কন্ডাক্ট (আচরণবিধি) বা কোড অব এথিক্স পড়াতে গেলেই সেই পেশার জন্য প্রযোজ্য কিছু আলাদা এথিক্স ছাড়াও এজমালি কয়েকটি এথিক্স সব পেশার জন্যই দেখতে পাই। বর্তমান এদেশের বিদ্যমান রাজনীতিকে আমি দেশসেবা, সমাজসেবা, জনসেবা বলতে দ্বিধান্বিত। এদেশে বরং রাজনীতিকে একটা পেশা, ব্যবসা, মিথ্যার বেসাতি, লাঠিয়াল বাহিনীগিরি, লুটতরাজ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করতে আমরা প্রস্তুত। সব পেশার এথিক্সগুলোর মধ্যে কয়েকটি এথিক্স এজমালি, যেমন-ইন্টিগ্রিটি, পেশাগত যোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও দায়িত্ব, অবজেক্টিভিটি ইত্যাদি।

ইন্টিগ্রিটি শব্দটা ছোট হলেও এর অর্থ ব্যাপক, যেমন-সততা, নৈতিকতা, সাধুতা, ন্যায়পরায়ণতা, অখণ্ডতা, চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। এসবের ব্যাখ্যা করতে গেলে জায়গা সংকুলান হবে না। শুধু হাতের আঙুলে গুনে দেখতে পারি সামাজিক মূল্যবোধের এ অবক্ষয়ের যুগে ক’জন রাজনীতিকের মধ্যে সততা, নৈতিকতা, বিশুদ্ধতা আছে। অবজেক্টিভিটি অর্থ নৈর্ব্যক্তিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা, ব্যক্তিনিরপেক্ষতা ইত্যাদি। এগুলো একজন রাজনীতিকের থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা একটু ভেবে দেখতে পারি। ব্যক্তি-নিরপেক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও দায়িত্ববোধই বা ক’জনের মধ্যে বিদ্যমান? এদেশে লাঠিবাজি, মাঠ-দখল ও ভাঁওতাবাজি রাজনীতির পেশাদারত্ব বলে বিবেচিত হয়। আসলে পেশাগত যোগ্যতার মধ্যে সততা, জনকল্যাণকামিতা, সমাজসেবার মানসিকতাকে আমরা রাজনীতিকদের পেশাগত যোগ্যতা হিসাবে গণ্য করতে পারি। এ অর্থে বিশ্বস্ততা ও দায়িত্বশীলতার অর্থও ব্যাপক। একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তি-গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করে, অন্যদের অর্থ ও অন্যান্য সম্পদের যত্ন ও জিম্মাদারত্ব করে। এদেশের ‘মহান’, ‘অতিমহান’ ও ‘চিরমহান’ নেতাকর্মীরা জিম্মাদারত্ব কথাটা বুঝেও বুঝতে চায় না, জনগণের সম্পদকে নিজের সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে। তারাই আবার এমপি নির্বাচনে প্রতিযোগিতাও করে। এজন্যই এদের জন্য কোড অব এথিক্স আইন আকারে বলবৎ করার প্রস্তাব দিতে হয় এবং সংস্কারের এ ভরা মৌসুমে রাজনীতিকদের মধ্যে এসব গুণের সন্নিবেশের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরতে হয়। এসব এখনই ভেবে দেখার সময় এসেছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দল ছাড়াও বাজারে নতুন দল এসেছে। নতুন দলে পুরোনো দলের দলছাড়া, ডিগবাজি মারা, মুখসর্বস্ব, সুযোগসন্ধানীরা যোগ দেয়নি। এর কারণ রাজনীতি তো ওদের জন্য লাভজনক একটা ব্যবসা। সামাজিক এ অবক্ষয়কে বিবেচনায় আনার জন্য সংস্কারকদের বারবার লিখছি, কাজ হচ্ছে না। তারা কানে দিয়েছে তুলো, পিঠে বেঁধেছে কুলো।

সেজন্য আবারও রাজনীতিতে কোড অব কন্ডাক্টের কথা বলি। এ পেশার নাম যেহেতু রাজনীতির পেশা, এখানে কোড অব কন্ডাক্টের মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ এবং ‘দেশ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ’ কোড দুটোও উল্লিখিত কন্ডাক্টের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। সংবিধানে সন্নিবেশিত করা ছাড়াও প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনেও সংযুক্ত করা যায়। নির্বাচন কমিশনের আইনের মধ্যে যোগ করা আর না করা একই কথা। তারপর আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে দেশ ও সমাজ উপকৃত হয়। আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট বা বহুকক্ষবিশিষ্ট করি বা না করি, এতে কাজের গুণগত মানের তেমন একটা যায়-আসে না; ফলোদয় নিয়ে প্রশ্ন আছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে আইনপ্রণেতারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন কিনা। আইন প্রণয়ন ছাড়াও তারা নিজ এলাকায় গিয়ে সরকারি আর্থিক বণ্টন নিজ হাতে করবেন কিনা। এলাকার প্রতিটি বৈধ-অবৈধ সমিতি থেকে অবাধে চাঁদা তুলবেন কিনা। বাস্তবতা বলে, এখানেই যত বিপত্তি। আমরা সংস্কারকরা চলতি সমাজ বিশ্লেষণ করতে ভুলে যাই। অপারেশন প্রয়োজন হার্টের, অপারেশন করি পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলের। তাই একাধিক ছিদ্রবিশিষ্ট আধাখেঁচড়া সংস্কারে ফলপ্রসূ কিছু না হলে আশাভঙ্গের কারণ হতে পারে। বিষয়টি তখন ঠান্ডা তেলে ফোড়ন দেওয়ার মতো ‘তেলের নামে তেল গেল ফ্যাচ করল না’-এ দশা হবে। আইনপ্রণেতারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ‘দামড়া গরুকে জলজ্যান্ত গাভি বানিয়ে ফেলবে’, এটি জনসাধারণের যেমন কাম্য নয়, তেমনি সম্মানিত আইনপ্রণেতার জন্যও শোভনীয় নয়। এ বোধ এদেশের ক’জন আইনপ্রণেতার আছে?

এদেশের কোনো এক দলের প্রধান বলেছেন, ‘আমাদের রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে।’ অতি সঠিক কথা, রাষ্ট পরিচালকদের এ বোধোদয় হলে দেশের জন্য উত্তম, শুনে ভালো লাগল। এই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার মেরামতটাও করে ফেললে কেমন হয়? মেরামতটা দেশ-উন্নয়নের জন্য ফলপ্রসূ হলেই জনগণ বাঁচে। রাজনীতি করব অথচ রাষ্ট্রের কাছে কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না, এটাইবা কেমন? রাষ্ট্র মেরামত করার সময় দলীয় নেতাকর্মীদের অসৎ কর্মকাণ্ড, দুর্বৃত্তায়ন থেকে দূরে রাখার জন্য একটি বিধিবদ্ধ আচরণবিধি থাকলে এবং তা মানতে বাধ্য থাকলে কতই না ভালো হয়! এতে সুশিক্ষিত সমাজসেবীরা ক্রমেই রাজনীতিতে আসবেন, জনসেবার দ্বার উন্মোচিত হবে।

দেশপ্রেমী, সুশিক্ষিত ও নীতিবান নেতাকর্মী ছাড়া আর কোনোভাবেই যে দেশ গড়া সম্ভব নয়, এটা কে না জানে! কোড অব কন্ডাক্ট প্রত্যেক নেতাকর্মীর মেনে চলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনেকে বলেন, নির্বাচিতরা দুর্নীতি বা অপরাজনীতি করলে পরবর্তীকালে তাকে জনগণ আর ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে না। এ তত্ত্বের সঙ্গে অনেকেই একমত নন, তত্ত্বটি বাস্তবানুগও নয়। দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীও এ কথা ভালো করেই জানেন। এদেশের মানুষের বর্তমান প্রকৃতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সমাজের দৈন্যদশা নিয়ে যারা নিত্য ভাবেন, তাদের এতে বিশ্বাস থাকার কথা নয়। এদেশে কুখ্যাত সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর, মুরগি মিলন গংও এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আবার হয়ও। তাই রাজনীতির অধিকাংশ নেতাকর্মীর চলতি মনোভাব সবাই বোঝেন, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক, দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ কোনো নেতাকর্মীর বর্তমান অপকর্মের ভার ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে না দিয়ে নির্বাচিত সময়ের মধ্যেই তার বিচার হওয়া উচিত। আবার কোনো কোনো নেতাকর্মীর দায়বদ্ধতার ভার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলইবা কাঁধে নিতে চাইবে কেন? যার পাপের বোঝা তাকেই বহন করা উচিত। অর্থাৎ রাজনীতিকদের অপকর্মের দায়বদ্ধতা আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। সেভাবেই আইন তৈরি করতে হবে; কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করতে হবে। আইন নেতাকর্মীদের কোড অব কন্ডাক্ট মানতে বাধ্য করবে। যে জেলের ছেলেকে কুমিরে খেয়েছে, তার ঢেঁকি দেখলেই ভয় পাওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু আমরা সে সুযোগ দেব কেন?

ড. হাসনান আহমেদ : সাহিত্যিক, গবেষক

pathorekhahasnan.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম