চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা, কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট শাসন এবং ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-কৃষক এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা এ গণ-আন্দোলন একদিকে যেমন স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ঘটিয়েছে, তেমনই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং একটি নতুন করে বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে উজ্জীবিত করেছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের সব মানুষ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্মতি প্রদান করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা এখন সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি এবং মুনাফাখোর সিন্ডিকেট সরকারের ব্যর্থতার বড় উদাহরণ। চাল, ডাল, তেল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে চলেছে, আর সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ১৫ শতাংশ ভ্যাটের কারণে পণ্যের দাম আরও বেড়েছে, ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। প্রতিদিন খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, লুটপাট চলছে-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে। অন্যদিকে মাজারে হামলাসহ কোনো মামলার বিচার হয়নি এবং হত্যা-ধর্ষণের অপরাধের তদন্ত ধীরগতির কারণে জনগণের অসন্তোষ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরে আসতে পারে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিসরে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা করেছে এবং এ প্রেক্ষাপটে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা জরুরি। এ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে বোঝানো হয় এমন একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন, যা রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করে নতুন সংবিধান এবং নতুন শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তন করে। আর গণপরিষদ নির্বাচন সাধারণত তখন হয়, যখন একটি রাষ্ট্র নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জাতীয় নাগরিক পার্টির মতে, বর্তমান সময়েও এমন একটি গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রকে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর দিকে নিয়ে যাবে।
এনসিপির দাবি, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন ছিল না, বরং এটি রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসানের লড়াই। তাদের মতে, বর্তমান সংবিধান গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সুসংহত করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই একটি নতুন সংবিধান প্রয়োজন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনে করে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন, তবে গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধানের দাবি অবাস্তব। তারা মনে করেন, ‘গণপরিষদ তখন হয়, যখন নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়। বাংলাদেশ কি ভেঙে পড়েছে? আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন, নতুন করে রাষ্ট্র বানানো নয়; যা বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক কেন হবে? গণপরিষদ কেন প্রয়োজন, বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ? আমাদের তো একটি নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানসহ নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা হচ্ছে। যারা সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নিয়ে আলোচনা করছেন, তারা হয় বুঝে না, নয়তো দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। নতুন সংবিধান নয়, আমাদের সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন বাদ দিয়ে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। যতদ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। অধিকাংশ বাম রাজনৈতিক দলের মতে, বর্তমান সংবিধানেই যথেষ্ট গণতান্ত্রিক স্পেস রয়েছে এবং এটি কার্যকর করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। তারপরও একান্ত প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন, সরকার যদি এনসিপির দাবি অনুযায়ী গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে আগায়, তাহলে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মৌলিক আইনি কাঠামো, যা ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মৌলিক অধিকার ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, সময়ের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ পরিবর্তন বা সংশোধন শুধু নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব, সংবিধান বাতিল করে নয়।
ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানো যেতে পারে। বাহাত্তরের সংবিধান জনগণের সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার ফসল; তাই যে কোনো পরিবর্তন জনগণের স্বার্থে হতে হবে, সংকীর্ণ স্বার্থে নয়। সংবিধান পুনর্লিখন নয়, বরং সময়ের প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট সংস্কার বিবেচনা করা যেতে পারে।
ড. আবু সাইয়িদ বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান বাঙালি জাতির হৃদয়ের প্রতিফলন এবং শহিদদের রক্তে লেখা দলিল। যারা এটি লঙ্ঘন করেছে, তারা ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়েছে। বর্তমানে কিছু রাজনৈতিক দল সংবিধান বাতিলের দাবি তুললেও তা রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান সংশোধন একটি বৈধ ও কার্যকর পন্থা। এর জন্য শক্তিশালী নির্বাচনি ব্যবস্থা, সুশাসন এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন।
নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম মূল ভিত্তি। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন সম্ভব। সংশোধনী প্রক্রিয়া সংসদীয় আলোচনার মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে এবং দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে কার্যকর হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য এবং জনগণের সমর্থন অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মতামত ও রাজনৈতিক বিতর্কের মাধ্যমে সংশোধন করা হলে তা দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশে সহায়ক হবে। সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন একটি গণতান্ত্রিক ও আইনসম্মত প্রক্রিয়া, যা রাজনৈতিক ঐকমত্য ও জনগণের সমর্থন ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যই শেষ কথা।
সংবিধান নয়, বাংলাদেশে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বৈারাচারী ও ফ্যাসিস্ট শাসনের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যাখ্যা, উন্নয়নের মোড়কে গণতন্ত্রহীনতা এবং ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’ তত্ত্বের মাধ্যমে শেখ হাসিনা একদলীয় স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘উন্নয়ন’কে একমাত্র গ্রহণযোগ্য বয়ান বানিয়ে ভিন্নমতকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছেন। বিরোধী দল দমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠরোধ করেছেন।
প্লেটো, অ্যারিস্টটল, বারবার, আরেন্ট ও লকের মতে, লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে স্বৈরাচারের জন্ম হয়। ইতিহাসে হিটলার, মুসোলিনি, ইদি আমিন, কিম জং উনের মতো শাসকরা গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসে পরে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট হয়েছেন। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রশাসন ও রাজনীতিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যান। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। বিরোধী দল ও মত দমনে পুলিশ, র্যাব, সেনা ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেন। হাজারও বিরোধী নেতাকর্মী খুন, গুম ও নির্যাতনের শিকার হন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের পরিবার ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়। ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনে তিনটি নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের মূল কারণ সংবিধান নয়, তার ব্যক্তিগত লোভ ও ক্ষমতা।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ধারণা মূলত এক ধরনের রাষ্ট্রের পুনর্গঠন বা পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত ঘটে যখন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নতুন করে নিজের কাঠামো বদলায়, যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক বা ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, পর্তুগালে ১৯২৬ সালে এবং চিলিতে ১৯৯০ সালে সেকেন্ড রিপাবলিক পুনরুদ্ধার হয়।
নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। হ্যাঁ, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, কাঠামো, ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে-একথা সর্বজনস্বীকৃত। এ বিদ্যমান কঠিন বাস্তবতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র-রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রয়োগ, বাস্তবায়ন, ধারণ ও অনুশীলন করতে হবে।
সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে