Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নতুন রাজনীতির সূচনা

Icon

ড. শেখ আকরাম আলী

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন রাজনীতির সূচনা

সংগৃহীত ছবি

একটি দেশের জন্য রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো একটি গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার। প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রাজনৈতিক দলগুলো কিছু মৌলিক নীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

যদি আমরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পটভূমি এবং উন্নতির কিছু ধারণা পেতে পারি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা ইংল্যান্ডে বিল অফ রাইটসের মাধ্যমে হয়েছিল। রিপাবলিকান পার্টি এবং টরি পার্টির সূচনা সতেরো শতকের শেষের দিকে এবং বর্তমানে এ দুটি দল কনজারভেটিভ পার্টি এবং লেবার পার্টি হিসাবে কাজ করছে। দুই দলই জন্মের পর থেকেই দেশের জন্য, জনগণের জন্য কাজ করে আসছে বিরামহীনভাবে। ব্রিটিশরা সফলভাবে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে এবং বিশ্বে উজ্জ্বল রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করেছে।

উনিশ শতকের শেষের দিকে একই ব্রিটিশরা প্রথমবারের মতো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা প্রথমে জনমত প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে এবং পরে একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। প্রাথমিকভাবে মুসলিম এবং হিন্দুরা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিল, তবে দ্রুত কংগ্রেস একটি হিন্দু প্রাধান্যযুক্ত রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে। ভারতের মুসলমানরা কংগ্রেসে যোগদান করতে উৎসাহিত হয়নি এবং তাদের নিজেদের একটি আলাদা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করে। এবং এভাবে ১৯০৬ সালে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের একমাত্র জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের স্বার্থের জন্য লড়াই করেছে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কখনো পাকিস্তানের জন্মকে হৃদয়ে মেনে নিতে পারেনি।

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে হতাশ হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটি পূর্ব পাকিস্তানে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শিগগির এর শীর্ষ নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে ওঠে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিরাপত্তাহীন অনুভব করেছিল এবং আওয়ামী লীগকে তাদের অধিকার রক্ষার প্রকৃত রক্ষক হিসাবে দেখেছিল। ছয় দফার দাবি তাকে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নেতা করে তোলে। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল, কিন্তু ক্ষমতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হস্তান্তর করা হয়নি। ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার, ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়। শেখ মুজিব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে আশ্রয় নেন, রেখে দেন পুরো বাঙালি জনগণকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর করুণায়।

এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এক তরুণ বাঙালি মেজর বিপ্লবী হয়ে ওঠেন এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন জিয়াউর রহমান, যিনি নিজের জীবন এবং পরিবারের জীবন ঝুঁকিতে রেখে এ সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মেজর জিয়া তখনই একটি জাতির নায়ক হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার পর নতুন দেশ বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু হয়, যা জাতীয় স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে উপেক্ষা করেছিল। শেখ মুজিব বাংলাদেশে সুপ্রিম নেতা হিসাবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্ত করে দেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমরা দেখতে পাই নতুন রাজনীতির সূচনা, যার মাধ্যমে জেএসডি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি শিগ্গির শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। তারা কিছু সময়ের জন্য রাজনীতিতে উগ্রতাবাদ নিয়ে আসে, তবে এর কোনো ভালো ফল হয়নি। শিগ্গির, দেশকে এক নতুন রাজনীতির সাক্ষী হতে হয়, যা কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না, তা হলো বাকশাল সৃষ্টি। এটি শুধু শেখ মুজিবকে নয়, বরং আওয়ামী লীগকেও বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব জিয়াকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে এবং তিনি আবারও বাংলাদেশের আধুনিক রূপ রচনার প্রতিপালক হিসাবে আবির্ভূত হন।

জাতি জিয়াউর রহমানের মধ্যে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেখেছিল, যিনি বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তার নেতৃত্বে পুরো জাতি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এটি একটি নতুন রাজনীতি, একটি নতুন পরিবেশে, যা জিয়াউর রহমান সৃষ্টি করেছিলেন, জাতির জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। তিনি দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতি খুলে দেন এবং আওয়ামী লীগকে আবারও রাজনীতি শুরু করার অনুমতি দেন। কিন্তু তার জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলো, শেখ হাসিনার বাংলাদেশে আগমনের ঠিক কয়েকদিন পরেই তার মৃত্যু হয়। এটি ছিল নিয়তির লীলা। তবে তার দুঃখজনক মৃত্যুর আগে তিনি একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা হলো বিএনপি প্রতিষ্ঠা। বিএনপি পরবর্তীকালে একটি প্রকৃত জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করেছে এবং দ্রুত বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে।

জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন একটি বাংলাদেশ গড়ার একটি নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে, কিন্তু এটি কে করবে? এটা এখন বড় প্রশ্ন। প্রথমত, এটি একটি পরিকল্পিত বিপ্লব ছিল না, দ্বিতীয়ত, এর কোনো একক শক্তিশালী নেতা ছিল না, এবং অবশেষে এর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না, শুধু ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছাড়া।

এটি একটি ঐতিহ্য, বিপ্লবের পর একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি জনগণের জন্য একটি ভিন্ন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিপ্লবটি কয়েকশ প্রাণের ত্যাগ এবং হাজার হাজার মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের ফলে সফল হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছিল, কারণ ছাত্রনেতারা তাদের জীবন ঝুঁকিতে রেখে এ কাজটি করেছিলেন। তবে এটি একক কোনো নেতার পরিবর্তে ছাত্রদের একটি টিমের নেতৃত্বের মাধ্যমে করা হয়েছে। এসব পরিচিত ও অজ্ঞাত ছাত্রনেতা নিঃসন্দেহে জাতীয় নায়ক এবং তাদের জন্য জাতীয় সম্মান প্রাপ্য। আমাদের যথাযোগ্য শ্রদ্ধা তাদের প্রতি সর্বদা থাকবে। এখন তারা যেভাবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং আমাদের পক্ষ থেকে একে স্বাগত জানানো উচিত। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ দলে তরুণরা আছেন, তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে অবশ্যই পরিণত ও অভিজ্ঞ নেতার প্রয়োজন। তবে আমরা নতুন দলে সে ধরনের নেতৃত্ব দেখতে পাচ্ছি না। নতুন রাজনীতি শুরু করতে হলে শুধু তরুণ নেতৃত্ব নয়, তাদের সঙ্গে কিছু মধ্যবর্তী স্তরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞ নেতা থাকা উচিত ছিল। যদি তাদের মধ্যে সিনিয়র ব্যক্তিত্ব থাকে, তবে তাদের সামনে নিয়ে আসা উচিত।

অনেকে মনে করেন, নতুন দলটি একটি পুরোনো রাজনৈতিক দলের সম্প্রসারণ। সবকিছু স্বচ্ছ হওয়া উচিত এবং রাজনীতিতে আর কোনো ছলচাতুরি চলা উচিত নয়। আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সফলতা দেখতে চাই। আমরা একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা দেখতে চাই। জুলাই বিপ্লবের পর, আমরা খুবই খুশি হব, যদি জনগণের এবং দেশের স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে নতুন রাজনীতির সূচনা দেখি নতুন পরিবেশে।

ড. শেখ আকরাম আলী : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম