নারীর সংগ্রামের যেন শেষ নেই

মনজু আরা বেগম
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। দিবসটির তাৎপর্য হলো, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেলাই কারখানায় নারীরা তাদের ভোটাধিকার, পরিবার ও সমাজে তাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বেশকিছু সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করলে তারা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। এ ঘটনাকে স্মরণে রাখার জন্য ১৯১০ সালে জার্মানির একজন নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন দিনটিকে ‘নারী দিবস’ হিসাবে পালনের প্রস্তাব করেন। ১৯১১ সালে প্রথম বিভিন্ন দেশে দিবসটি বেসরকারিভাবে পালন করা হয়। এরপর দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৪ সালে মার্চ মাসের ৮ তারিখকে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সরকারিভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশও প্রতিবছর নতুন নতুন প্রত্যয় আর অঙ্গীকার নিয়ে দিবসটি পালন করে। কিন্তু সে প্রত্যয় ও অঙ্গীকার যেন এই একটি দিনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ সীমাবদ্ধতার কারণে সমাজের সর্বত্র নারীরা নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন, সেই সঙ্গে হচ্ছেন বৈষম্যের শিকার।
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পরিবার, সমাজ তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। দেশের নারী সমাজও এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে যিনি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি নারী জাতির অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া। অন্ধকার জগৎ থেকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে তিনি নারী জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নারীকে চার দেওয়ালের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে আলোর সন্ধান দিয়েছেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে নারীরা আজ সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করছে। তাই এই দিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ সময়েও যে জায়গাটায় এখনো অগ্রসর হতে পারেনি সেটা হলো নারীর সমতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বহু দেশেই পুরুষরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। পুরুষরা মুখে নারীর অগ্রযাত্রার কথা যতই বলুক না কেন, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বহাল রাখে, যা নারীর অগ্রযাত্রার পথে এখনো বাধা হিসাবে কাজ করছে। এসব অতিক্রম করার চেষ্টা চললেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আজও সমতা আনা সম্ভব হয়নি। তাই নারীরা ঘরে-বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে, পথে-ঘাটে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এসব বন্ধের জন্য আইন আছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। দেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০১৩ সালে এ আইনকে সংশোধন করে শাস্তি আরও কঠোর করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আইনের প্রয়োগ কঠোরভাবে না হওয়ায় এর ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বস্তুত নারীরা ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নেই। একুশ শতকের শেষ প্রান্তে এসেও দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ও কন্যাশিশুরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার মতো সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এসব ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজশাহীগামী চলন্ত একটি বাসে ডাকাতিসহ দুজন নারীযাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসেও রংপুরের মিঠাপুকুরে একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, এরপর তাকে হত্যা করা হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে একজন পোশাক কর্মীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ ধরনের বহু ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে।
নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হলেও পুরুষশাসিত সমাজে নারীর ক্ষমতায়নকে অনেক পুরুষই মেনে নিতে পারেন না। নারীর অগ্রগতির পথে তারা প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করেন। এ ছাড়াও প্রবীণ নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। তাদের সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলেন না। আইন ও গণসচেতনতার মাধ্যমে প্রবীণ নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল হচ্ছে তার ঘর। নারীরা অবমূল্যায়িত হচ্ছে সমাজ, সংসারে। তাহলে নারীর নিরাপত্তা কে দেবে? আজ এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
এদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। এ বিপুলসংখ্যক নারী যদি দেশের উন্নয়নে কাজ না করত বা অবদান না রাখত, তাহলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হতো না। নারীরা পরিবার ও সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায়ের জন্য ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংগ্রামের যেন শেষ নেই। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সোচ্চার ও সংগঠিত হতে হবে। আইনের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গণমাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
জানা গেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নতুন আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। তবে আইন শুধু প্রণয়ন করলেই চলবে না, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ যাবতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আগামী বাজেটে আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর যে জেন্ডার বাজেট হয়, তা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১ শতাংশের মতো, যা বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সমাজ থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে পরিবার ও সমাজে নারীদের সম্মানজনক অবস্থান আরও সুদৃঢ় করার পাশাপাশি সমতা আনতে হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এটাই নারী সমাজের প্রত্যাশা।
মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com