ইন্দো-মার্কিন-মইন ত্রয়ীই ছিল যত নষ্টের গোড়া

মোবায়েদুর রহমান
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67ca0c3087f0e.jpg)
শুধু বিডিআর ম্যাসাকার নয়, বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষপুটে ঠেলে দেওয়ার জন্য আরও অনেক গণহত্যার প্রয়োজন ছিল ভারতের। এজন্য তাদের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশে এমন একটি সরকার, যারা হবে ভারতের হুকুম বরদার। এজন্য ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ইন্দো-মার্কিন যোগসাজশে বাংলাদেশে একটি সাজানো নির্বাচন করে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হয়। অনেকেই বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন তো ফ্রি এবং ফেয়ার হয়েছিল। আমি সবিনয়ে বলতে চাই, না, ওই নির্বাচনের ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। এটি আমার কথা নয়। আমার এ বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য আমি যুগান্তরের সম্মানিত পাঠকদের জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের একটি টেলিফোনিক সংলাপের ট্রান্সক্রিপ্ট নিচে হুবহু তুলে দিলাম।
তাদের টেলিফোন সংলাপ শুরু হয় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে হিলারি ক্লিনটন বলেন, Madame Prime Minister, I thought I would not have to go that far. But, unfortunately, I was wrong. I hope you know as much we know, how your government came to power. Don't forget that we helped you by congratulating you after the election terming it as a free and fair. You know Prime Minister, how this election result was pre-arranged at the behest of our good friends in New Delhi. We acted the way they suggested us. And please don't forget that Gen. Moeen, who brought you to power, now in the USA and perhaps, we now know, more than you could possibly imagine. Prime Minister, I am not saying that we will disown you so soon. I am just trying to place issues in the order of history demands it.
At this point, Prime Minister tried to change the subject and said, Madame Secretary we are aware of your support and assistance. We will do all we can to keep you happy. Don't worry. We noted your point.
বঙ্গানুবাদ : ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, আমি ভেবেছিলাম আমাকে এত দূরে যেতে হবে না। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি ভুল ভেবেছিলাম। আপনি জানেন এবং আমরাও জানি কীভাবে আপনার সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ভুলে যাবেন না, নির্বাচনের পর আমরা বলেছিলাম, সেটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে এবং আপনাকে সাহায্য করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন, দিল্লিতে আমাদের বন্ধুদের নির্দেশে কীভাবে ফলাফল আগেই ঠিক করা হয়েছিল। তারা যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবেই আমরা চলেছিলাম। প্লিজ, আপনি এটা ভুলে যাবেন না, জেনারেল মইন, যিনি আপনাকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তিনি এখন আমেরিকাতে আছেন এবং আপনি যতখানি কল্পনা করতে পারেন, তার চেয়েও বেশি এখন আমরা জানি। আমি বলছি না, আমরা এখনই আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাব। আমি শুধু ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ইস্যু তুলে ধরছি।
২.
সম্মানিত পাঠক ভাইদের আর আঁটি ভেঙে শাঁস দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমেরিকা, ভারত এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ-এই ত্রয়ী মিলে বাংলাদেশে ২০০৮ সালের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। জেনারেল মইনের স্বার্থ ছিল সেফ এক্সিট। আমেরিকা তখন ‘ওয়ার অন টেরর’ নিয়ে পেরেশান ছিল। ভারত আমেরিকাকে বুঝিয়েছিল, বিএনপি অথবা বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ কায়েম হবে। আমেরিকা ভেবেছিল, ভারতের জিম্মায় বাংলাদেশকে দিলে ভারত হাসিনাকে সেবাদাসী করতে পারবে। আর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছিলেন রাজনীতি করার জন্য নয়। তিনি এসেছিলেন তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে (তিনি যে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজনীতিতে এসেছেন সে সম্পর্কিত ডকুমেন্ট আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে)।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতার গদিতে বসেন। এরপর সংঘটিত করেন একের পর এক জেনোসাইড বা গণহত্যা। প্রথমে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ১ মাস ১৯ দিন পর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিক কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন কর্মকর্তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করান। এরপর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়, সেসব প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলি করে ২৫৩ জন আলেম এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করেন।
তৃতীয় গণহত্যাটি সংঘটিত হয় লম্বা সময় নিয়ে। এটি হলো Enforced Disappearance বা গুম ও খুনের মাধ্যমে। এর আরেকটি হাতিয়ার ছিল কুখ্যাত আয়নাঘর। সুইডেনের অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘নেত্র নিউজের’ তাসনিম খলিল উপগ্রহ থেকে ধারণকৃত ছবিতে দেখান, সেনানিবাসের অভ্যন্তরে অন্তত দুটি আয়নাঘর রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সারাদেশে কম করে হলেও সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০টি আয়নাঘর রয়েছে। তার তথ্যমতে, কম করে হলেও সাড়ে ৩ হাজার ব্যক্তি গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন। ৫ মার্চ সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক গুম তদন্ত কমিশন জানিয়েছেন, যাদের গুম করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৩৩০ জন এখনো নিখোঁজ। ধারণা করা হচ্ছে, এরা সম্ভবত আর বেঁচে নেই। এভাবে একের পর এক ধারাবাহিক গণহত্যার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। দেশে সৃষ্টি করা হয় রক্ত হিম করা পরিবেশ, যাতে করে জনগণ কণ্ঠরুদ্ধ থাকেন। আর সেই সুযোগে তিনি নাৎসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট ও ভয়াবহ কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে Kleptocracy বা চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেন, পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ঋণখেলাপি করে ব্যাংকগুলোতে লালবাতি জ্বালালেন এবং শেখ পরিবার এবং কয়েকজন লুটেরাকে নিয়ে Crony Capitalism প্রতিষ্ঠা করেন।
তার চতুর্থ জেনোসাইড ছিল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা এবং ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে আহত করা, যাদের মধ্যে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা হাত-পা হারিয়েছেন এবং কেউ কেউ চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।
৩.
এ ভয়ংকর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম শুরু হয় বিডিআর ম্যাসাকারের মাধ্যমে। শুরুতে শেখ হাসিনা এ গণহত্যার দায় চাপাতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত জননেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওপর। তিনি রূপকথার মতো গল্প সাজিয়ে বলেছিলেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া ওইদিন সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে যান। সারাদিন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এর উত্তরে বেগম খালেদা জিয়া কোনোরূপ রাখঢাক না করে ব্লান্টলি বলেছেন, হাসিনাই এ গণহত্যার জন্য দায়ী। তিনি প্রশ্ন করেন, হাসিনা আসার এক মাস পরেই কেন এটা ঘটল? হাসিনা সবকিছু জানত। এজন্যই সে আগের রাতে ডিনারে যায়নি। কেন সে ডিনারে যায়নি? বেগম জিয়া আরও বলেন, সে ডিনারে গেল না। তার পরদিন কেন এ ঘটনা ঘটল? হাসিনা এবং মইন উদ্দিন এটা জানত। সেজন্যই এটা মানা যায় না। বেগম জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, এজন্য হাসিনাকে একদিন জবাব দিতেই হবে। কর্নেল গুলজার আটক করেছিলেন শায়খ আবদুর রহমানকে। শায়খ আবদুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের ভগ্নিপতি। এ গ্রেফতারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কর্নেল গুলজারকে হত্যা করা হয়েছে। কনক সরওয়ারের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত এক ভিডিওতে তিনি এ বক্তব্য দেন। এ বক্তব্য দেওয়ার সময় তার পুত্র বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান তার পাশে উপবিষ্ট ছিলেন। ৭ মিনিটের এ ভিডিও ক্লিপটির সমগ্র বক্তব্য স্থান সংকুলান হবে না বলে এখানে দেওয়া হলো না। তবে আমাদের কম্পিউটারে এটি সংরক্ষিত আছে।
বিডিআর ম্যাসাকারে যে আওয়ামী লীগ জড়িত ছিল, সেটি প্রকাশ করেছেন উইকিলিকসের দুঃসাহসী সাংবাদিক জুলিয়াস অ্যাসাঞ্জ এবং বিশ্ববিখ্যাত অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া। উইকিপিডিয়ায় এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার অংশবিশেষ নিম্নে হুবহু উদ্ধৃত করা হলো, ‘সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ হত্যাকাণ্ডের যে তদন্ত আদালতে করা হয়েছিল, তার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন। জুলাই অভ্যুত্থানের পরে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে তার তদন্তের সারাংশ তুলে ধরেন। তদন্তে তিনি জানতে পেরেছিলেন, বেশ আগে থেকেই আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে এ ব্যাপারে বিডিআর জওয়ানরা পরিকল্পনা করে আসছিল। ২০০৮ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বাসাতে হাবিলদার মনির, সিপাহি শাহাব, সিপাহি মনির বৈঠক করেন। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় বিডিআর দরবারসংলগ্ন মাঠে সিপাহি কাজল, সেলিম, মঈন, রেজা এবং বেসামরিক ব্যক্তি জাকিরসহ কয়েকজন বৈঠক করেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় রাজধানীর বনানীতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের বাসায় বিডিআরের ডিএডি হাবিব, ডিএডি জলিল, ল্যান্সনায়েক রেজাউল, হাবিলদার মনির, সিপাহি সেলিম, কাজল, শাহাবউদ্দিন, একরাম, আইয়ুব, মঈন, রুবেল, মাসুদ, শাহাদত ও জাকির (বেসামরিক) বৈঠক করেন। এর আগে-পরেও বিডিআর সদস্যরা বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। সুবেদার গোফরান মল্লিক নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। উইকিলিকসে উন্মুক্ত হওয়া নথিতে জানা যায়, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিব শংকর মেননকে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান। সোয়াচের অধ্যাপক আভিনাশ পালিওয়াল তার সাম্প্রতিক বইতে জানিয়েছেন, হাসিনাকে উদ্ধার করতে তখন প্রায় ১০০০ ভারতীয় ছত্রীসেনা পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুা বিমানঘাঁটিতে অবস্থান নেয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে ভারত সতর্ক করে বিদ্রোহী জওয়ানদের ধরার চেষ্টা যাতে না করা হয়। অন্যথায় ভারত সামরিক হামলা চালাবে। এতে জেনারেল মইন পিছিয়ে আসেন। পদুয়া-রৌমারি বর্ডারে বিডিআরের হাতে ভারতের পরাজয় এবং পিতার মৃত্যুর জন্য সেনাবাহিনীর দায় মেটানো ইত্যাদি কারণ অনুমান করা হয় বিদ্রোহের সঙ্গে ভারত-আওয়ামী লীগ সম্পর্কের কারণ ব্যাখ্যা করতে।’
বিডিআর ম্যাসাকারের পুনঃতদন্তের জন্য সাবেক বিডিআর ডিজি মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে গত ২২ ডিসেম্বর একটি কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশনকে তিন মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের অনেক অজানা অধ্যায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। এ ব্যান্ড ওয়াগনে গত ৪ মার্চ মঙ্গলবার আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে একটি ৪৬ মিনিটের ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। সেখানে তিনি নিজের সাফাই গেয়েছেন। একই নিশ্বাসে তিনি সাফ বলেছেন, যে মুহূর্তে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তার ২ ঘণ্টার মধ্যেই পদাতিক বাহিনীর ট্যাংক এবং আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) পিলখানা অভিমুখে যাত্রা করে। মাঝখানে স্বয়ং শেখ হাসিনা তাদের থামিয়ে দেন।
পিলখানা ম্যাসাকার নিয়ে বিগত ১০/১২ দিনে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ওদের শেষ রক্ষা হবে না। থলের বেড়াল বের হতে শুরু করেছে। জনগণ জেনারেল ফজলুর রহমানের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
মোবায়েদুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক
journalist15@gmail.com