Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রাজনীতির মাঠে ভোটের হিসাব

Icon

আমিরুল ইসলাম কাগজী

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনীতির মাঠে ভোটের হিসাব

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি, সংক্ষেপে এনসিপি। সংক্ষিপ্ত নামটি হওয়া উচিত ছিল জানাপা। কিন্তু তারা ইংরেজি-বাংলা মিশেলে সংক্ষিপ্ত নামটি সামনে এনেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা মিলেমিশে এ সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন। নেতাদের মুখে স্লোগান ছিল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে দ্বিদলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক ধারার অভাব বোধ করছিল বাংলাদেশের সুশীল সমাজ। তাদের বক্তব্য ছিল এমন : ‘আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।’ আশা করি, সুশীল সমাজের সেই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্রদের নতুন সংগঠন এনসিপি আশার আলো দেখাবে। কিন্তু এনসিপি তাদের ঘোষণাপত্রে দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে নতুন এমন কী আদর্শ-উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেছে, যার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হবে? ঘোষণা অনুযায়ী, তাদের রাজনীতি হবে পরিপূর্ণ বাংলাদেশি। কোনো এক ব্যক্তির দল হবে না এটি। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা হবে। জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। কল্যাণরাষ্ট্র গঠন করার জন্য তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলবে। কোনো সরকার যাতে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য সংবিধান পুনর্লিখন চায় তারা। বাংলাদেশকে তারা সেকেন্ড রিপাবলিক বানাতে চায়। অন্য সব রাজনৈতিক দলের যেমন উদ্দেশ্য-আদর্শ থাকে, তার থেকে ব্যতিক্রম কি কিছু আছে এ দলটিতে? তবে বলা যায়, সেকেন্ড রিপাবলিক নামে একটি পুরোনো ধারণা নতুন করে সামনে এনেছে। সেটা সাধারণ মানুষ কতটা গ্রহণ করবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেনি বাংলাদেশের মানুষ। তবে সিপিবি এবং ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি কিছুটা জায়গা করে নিয়েছিল আদমজী পাটকল এলাকায় শ্রমিকদের এবং উত্তরবঙ্গের কৃষকের মধ্যে। সিপিবির আগের মতো সেই ধার এখন আর নেই।

ছাত্রদের এ নতুন সংগঠন করার পেছনে কার কী শক্তি আছে, কার কী মদদ আছে, এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ছাত্রদের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টার পদ ছেড়ে এ দলের হাল ধরেছেন। বাকি দুজন সরকারে আছেন। নাহিদকে বুকে জড়িয়ে ধরে নতুন দল গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শুভেচ্ছা বিদায় জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্রদের নতুন দল গঠনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। একদিন তিনি যদি এ দলটির হাল ধরেন, তাতেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। প্যারিসে তিনি রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চায়। তারা নির্বাচন করতে চায়। ফলে বলা যায়, এ ছাত্রদের ওপর তার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। ছাত্রদের এ সংগঠনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসুক, এটি তিনি মনেপ্রাণে সমর্থন করেন।

কিন্তু বাংলাদেশের ভোটের মাঠ কী বলে, সেদিকে একটু নজর দিয়ে আসতে পারি। নির্মোহ আলোচনা করতে হবে। বিএনপিকে গত ১৫ বছর নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে কেবল তাদের ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে। অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল করা সম্ভব হয়নি। হত্যা-গুম-খুন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে বন্ধ করা যায়নি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। দলটি এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তাদের ভোট ৪০ শতাংশের নিচে নামানো কঠিন। পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। হাজার চেষ্টা করেও তাদের ভোট বাক্সে হানা দেওয়া সম্ভব নয়। যদি কোনো দল ভাবে, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের সমর্থন পাবে, তাহলে নিশ্চিত ধরে নিতে হবে, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। আওয়ামী লীগ যদি দলগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নাও করে, তাহলেও তাদের ছায়া প্রার্থী থাকবে। ভোটের মাঠ বলে দেবে তাদের ছায়া প্রার্থী কে। তৃতীয় শক্তি হিসাবে আছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিগত দিনে তারা জোটগত এবং দলীয় ভিত্তিতেও নির্বাচন করেছে। দলীয় ভিত্তিতে এককভাবে যখন নির্বাচন করেছে, তখন তাদের ভোটের হার ছিল ৮.৬১। এখন সেটা কত বাড়তে পারে? সে হিসাবে নাইবা গেলাম। নতুন দল যারা গঠন করেছে, তারা কোন ভোট ব্যাংকে হানা দিতে চায়। কিংবা আরও একটু খোলাসা করে বলতে গেলে বলতে হয়, কোন ভোটারের ওপর নির্ভর করে তারা নির্বাচনে আসতে চায়।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ছাত্রদের যে জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেটা চোখে পড়ার মতো। এদের অবস্থান শিক্ষাঙ্গনে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তারা কতটুকু প্রভাব রাখতে পারবে, সেটা অবশ্য এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। অনেক বিশ্লেষক হয়তো বলতে পারেন, এ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও ভোটার। পিতা-মাতারা সন্তানের ওপর ভরসা রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিভাবকদের এ সংখ্যা কত? তার ওপর সংগঠনের নেতৃত্বে যারা এসেছেন, তারা সবাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাখা হয়নি তাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সে ক্ষেত্রে একটা বিরোধ শুরু থেকেই দৃশ্যমান। ফলে অভিভাবকরাও দ্বিধাবিভক্ত।

নতুন ছাত্র সংগঠন এমন কোনো আদর্শ-উদ্দেশ্য কী ঘোষণা করেছেন, যার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জনগণ রাতারাতি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বেন? ছাত্রদের নতুন নেতৃত্ব এখনো পর্যন্ত শহরাঞ্চলে সভা-সমাবেশ করছেন। গ্রাম-গঞ্জে তাদের পদধূলি এখনো পড়েনি। সেখানে এখনো ঘুরেফিরে তিনটি দলের নাম উচ্চারিত হয়। এনসিপি একেবারেই নতুন। এমন নতুন সংগঠনের কথা স্বাধীনতার পর থেকে বহুবার উচ্চারিত হয়ে এসেছে। কিন্তু খুব বেশি টিকে থাকতে পারেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ গঠিত হয়েছিল ছাত্রদের নেতৃত্বে। সদ্যস্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন-লুটপাট-দুর্নীতি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা ছিল সোচ্চার। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। মানুষের কল্যাণের কথা বলেছে; খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার কথা বলেছে।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ যখন সামরিক শাসন দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করল, তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিপরীতে তৃতীয় ধারার রাজনীতি শুরুর চেষ্টা করলেন। তিনি ক্ষমতায় থেকেই জাতীয় পার্টি গঠন করলেন। টানা নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন বটে, কিন্তু স্বস্তিতে ছিলেন না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তাকে নির্মমভাবে প্রস্থান করতে হয় ক্ষমতা থেকে। এরপর থেকে অনেক কলাকৌশল করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত টিকে ছিল দলটি। আওয়ামী লীগের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওই জাতীয় পার্টিরও পতন হয়ে গেছে বলা যায়। এখন রংপুরে গেলেও এ জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মার খেতে পারে। ১৯৭৮ সাল থেকে ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থান নিয়ে বিএনপি যেভাবে কাজ করে এসেছে, তার পেছনে রয়েছে একটি বিশাল জনসমর্থন। এ জনসমর্থনের হিসাব কষে ছিলেন বিগত স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিএনপি যখন বিজয়ী হলো, শেখ হাসিনা তখন থেকেই বুঝে ফেলেছেন বিএনপিকে পরাজিত করা কঠিন। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং বর্তমানে লন্ডন থেকে নেতৃত্ব দেওয়া তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি আরও অনেক অনেক শক্তিশালী। এজন্য শেখ হাসিনা বিগত ১৫-১৬ বছর নানা কৌশলে বিএনপিকে ভোটের বাইরে রেখেছেন। জনগণের একটি বিশাল অংশকে রাজনীতির বাইরে রেখে দেশ পরিচালনা করার পরিণতি কী হতে পারে, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন শেখ হাসিনা। শেখ মুজিবের মূর্তি যখন হাতুড়িপেটা করে টুকরো টুকরো করে ভাঙা হচ্ছিল, সেই দৃশ্য দেখে শেখ হাসিনা গোপন আস্তানা থেকে ইউটিউবে বলেছেন, দেশে কি এমন একটি মানুষ নেই, এসে প্রতিবাদ করতে পারে? দলের কিছু মানুষকে সুবিধা দিতে গিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করার খেসারত তাকে আজ দিতে হচ্ছে।

শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত রাখা। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল নিশ্চিত করলে তার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।

আমিরুল ইসলাম কাগজী : সিনিয়র সাংবাদিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম