Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

প্রতীকী ছবি

আপিল বিভাগ কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। দেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই চাচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হোক। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এখন সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না।

বিশ্বের কোনো উন্নত ও উদার গণতান্ত্রিক দেশে কখনোই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। তারা দলীয় সরকারের অধীনেই গ্রহণযোগ্য ও বিতর্কহীন নির্বাচনের আয়োজন করে থাকে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোনো নির্বাচন নিয়েই তেমন একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয় না। গণতান্ত্রিক দেশের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি কাজ। কারণ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসই প্রকাশ পায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাইরের বিশ্বে সংশ্লিষ্ট দেশটি সম্পর্কে ভুল বার্তা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ নিজেকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে দাবি করলেও এখনো এখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পর আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস আমাদের রাজনৈতিক কালচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উন্নয়নকে করছে ব্যাহত। গণতান্ত্রিক বিশ্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও আমাদের দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প এখন আর নেই।

বাংলাদেশ সংবিধানস্বীকৃত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু এখনো আমাদের দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনোটিই প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। প্রতিটি নির্বাচনেই দলীয় সরকার কর্তৃক প্রভাব বিস্তারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারদলীয় প্রার্থীদের জয়ী করানো হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনোটিই বিতর্কহীন ছিল না। উন্নত দেশগুলোয় জাতীয় নির্বাচনে যেসব দল পরাজিত হয়, তারা প্রশ্নাতীতভাবে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন যেমন নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীনভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি, তেমনই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের ফলাফল স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেয়নি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজিত যেসব নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে, সেসব নির্বাচনও পরাজিত দল প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়নি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারটি নির্বাচন (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যদিও নির্বাচনে পরাজিত প্রধান রাজনৈতিক দল কখনোই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এটি স্বীকার করেনি। বরং নানা ধরনের কল্পিত অভিযোগ উত্থাপন করে নির্বাচনের ফলাফলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে। যদিও দেশের মানুষের কাছে তা হালে পানি পায়নি।

বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত হয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উত্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো এ দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে ঠিকই, কিন্তু সেই সময় যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা না হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর কখনোই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজন করত না। তাদের সাম্প্রতিক আচরণ দেখে সেটাই প্রতীয়মান হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলই পরপর দুবার ক্ষমতায় আসীন হতে পারেনি।

একজন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় জনগণ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন করে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা জনকল্যাণের বিষয়টি ভুলে গিয়ে আত্মকল্যাণে নিয়োজিত হয়। ফলে জনগণ আশাহত হয়। পরবর্তী নির্বাচনে তারা নতুন কোনো রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর জন্য চেষ্টা করে। আর সেটা না পাওয়া গেলে আগের সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলকেই আবারও ক্ষমতায় নিয়ে আসে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্লিখিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মন্তব্যের বাস্তব প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো গণভিত্তি নেই। এ ধরনের সরকার সাধারণত দুর্বল হয়ে থাকে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একটি দেশে জাতীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, যদি রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রমনা হয় এবং জনরায় মেনে নেওয়ার মতো উদারতা প্রদর্শন করতে পারে। গণতন্ত্রের মূল সৌন্দর্যই হচ্ছে ভিন্নমত এবং জনরায়কে সম্মান জানানো এবং গ্রহণ করা। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই পরাজয় মেনে নিতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার।’

আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসীন হন, তারাই পরবর্তীকালে এ ব্যবস্থাকে বিতর্কিত ও কলুষিত করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর একটি দলের আহ্বানে কর্মীরা লগি-বৈঠা নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে। জাতি সেই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এটি ছিল একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। দেশ দুই বছরের বেশি সময়ের জন্য সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। সেই সময় দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

সর্বশেষ আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেয়। দেশের মানুষ দেখেছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন কতটা কুৎসিত ও বিতর্কিত ছিল। সাধারণ ভোটাররা নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। কোনো বিবেকবান মানুষ কখনোই চাইতে পারে না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি গণভিত্তিহীন ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু দেশের যা অবস্থা, তাতে এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও বিতর্কহীন নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তাই এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প চিন্তা না করে আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হলে তা বিতর্কমুক্ত থাকতে পারবে। উল্লেখ্য, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও একটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, আগামী দিনে ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দলই যেন একতরফাভাবে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাতিল বা কলুষিত করতে না পারে। এমন একটি ব্যবস্থা বা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, তাদের যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো সংশয় না থাকে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আবশ্যিক সংস্কারকার্য সম্পাদন শেষে তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। পরবর্তীকালে যারা নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবেন, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংসদে বিল পাশের মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবেন। ভবিষ্যতে কোনো সরকারই যেন জনমত যাচাই না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল না করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধানে এমন একটি ধারা যুক্ত করা যেতে পারে-তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করতে হলে প্রথমেই গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির মাধ্যমে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। জনগণ যদি মনে করে দেশে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন নেই, শুধু তখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা যেতে পারে। কোনো দলীয় সরকার তার ইচ্ছামতো কোর্টকে ব্যবহার করে যাতে ২০১১ সালের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে যে কোনো সংস্কার বা সংযোজন-বিয়োজন করার প্রয়োজন হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ততদিনই থাকবে, যতদিন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো উদার গণতান্ত্রিক চরিত্রের পরিচয় দিতে না পারবে। কোনো ব্যবস্থা বা পদ্ধতিই চিরস্থায়ী নয়। তবে এ মুহূর্তে দেশের কল্যাণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই।

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম