Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিএনপির ‘লুক ফরোওয়ার্ড’ কৃষিনীতি

Icon

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপির ‘লুক ফরোওয়ার্ড’ কৃষিনীতি

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উদ্যোক্তা তৈরি না করে কর্মসংস্থান খোঁজার জন্য নতুন প্রজন্ম তৈরি করছে।’ বাংলাদেশের ‘কৃষি বিপ্লবের জনক’ শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সেই কৃষি খাত আজ এককভাবে ৪০ শতাংশ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে ন্যাশনাল জিডিপিতে শতকরা ১৪.১০ ভাগ অবদান রাখছে (১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দৈনিক কালবেলা)। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিখাতে উদ্যোক্তা শ্রেণি হলো কৃষক, সেই কৃষকের অবস্থা আজ কী, তা আমরা সবাই জানি। কেবল সরকারের ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ, কৃষি উপকরণের (সার, বীজ, কীটনাশক ও বিদ্যুৎ) অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃত্রিম সংকট, সেচের অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, দুর্বল বাজারব্যবস্থা, সীমিত ও অঞ্চলভিত্তিক কোল্ডস্টোরেজ এবং ডিমান্ড-সাপ্লাই ডেটাবেসের গরমিলের কারণে কৃষি ও কৃষকের অবস্থা আজ রুগ্ণ। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি সুসংগঠিত কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছেন তা নিম্নরূপ-

ফার্মার্স কার্ড : বিএনপি দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে দেশের প্রত্যেক কৃষক ‘ফার্মার্স কার্ড’-এর আওতায় চলে আসবে, যা দিয়ে একজন কৃষকের প্রতি মৌসুমে যে পরিমাণ সার-বীজ বা ঋণ দরকার, তা অনায়াসে ঘরে বসে পাবেন। উন্নত মানের বীজের দুষ্প্রাপ্যতা বাংলাদেশের কৃষকের একটি কঠিন সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানকল্পে প্রত্যেক উপজেলায় বীজ বর্ধন ও প্রক্রিয়াকরণ খামার গড়ে তোলা হবে। হার্ভেস্টিংয়ের সময় পণ্যের দাম কম থাকে বিধায় কৃষকরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন, সে কারণে কৃষিপণ্য সংরক্ষণনীতি ওই ফার্মার্স কার্ডে থাকা বাঞ্ছনীয়।

খাল পুনঃখনন কর্মসূচি চালু : সেচ মৌসুমে কৃষকের পানির সুবিধা, সংরক্ষণ ও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসূচি আবার শুরু করবে। সেচের পানির প্রাপ্যতা এবং জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য খাল-খনন ও নদীশাসন কার্যক্রম জোরদার ও সম্প্রসারণ করা হবে।

বাজারব্যবস্থা আধুনিকীকরণ : বাজার প্রক্রিয়াকে নানাভাবে প্রভাবিত করার ফলে কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। মূল্য সমর্থন এবং উপকরণ ভর্তুকির সঠিক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কৃষক যাতে তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়, সে ব্যবস্থা করা হবে। প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে ডেটাবেস গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় সমর্থন পাওয়ার যোগ্য কৃষকদের তালিকা করা হবে। উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরকে সমন্বিত করে ঊর্ধ্বমুখী সমবায় পদ্ধতি গড়ে তুলে ফসলের দেখভাল, বাছাইকরণ, মজুতকরণ এবং পরিবহণ সুবিধা সরাসরি কৃষকের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সমর্থন প্রদান করা হবে।

ক্রপ-জোনিং কার্যক্রম : তীব্র জন-ঘনত্ব এবং ক্রম সংকোচনশীল কৃষিজমি বিবেচনায় নিয়ে উদ্ভাবনমূলক কৃষি কৌশল গ্রহণ করা হবে। সমতল, পাহাড় ও হাওড়-বাঁওড় এলাকার জন্য বিশেষ ফসল চাষের উপযোগিতা রেখে ক্রপ-জোনিংয়ে উৎসাহিত করা হবে। কৃষকদের উচ্চফলনশীল এবং উচ্চমূল্যের ফসল চাষে উৎসাহিত করা হবে। এক্ষেত্রে কৃষকদের প্রয়াস টেকসই করার জন্য সঠিক বাজারজাতকরণে নীতি প্রণয়ন করা হবে। কৃষিজমির অকৃষি ব্যবহার সাধ্যমতো বন্ধ করা হবে। গ্রামাঞ্চলে গুচ্ছবসতির মাধ্যমে কৃষিজমির অকৃষি ব্যবহার রোধ করা হবে।

প্রতিযোগিতামূলক পরিবহণব্যবস্থা জোরদারকরণ : একজন প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি যদি তার পণ্য পাইকারি বাজারে সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার জন্য রেল, সড়ক ও জলপথ পরিবহণের অপশন পায়, সে অবশ্যই স্বল্প খরচে ও মধ্যস্বত্তভোগীদের না দিয়ে তার পণ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করবে। এতে অবশ্যই বাজারে পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে। দেশের বিভিন্ন উৎস থেকে ঢাকায় যেসব পণ্য আসে তার সিংহভাগ (৯৫ শতাংশ) আসে সড়কপথে। ফলে সিন্ডিকেট চলে (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩০ নভেম্বর ২০২৪)। উদাহারণ, বগুড়া থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ১৫ টন সবজি নিয়ে আসা একটি ট্র্যাকের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। ২৪০ কিলোমিটার এ পথে অন্তত ১০ জায়গায় মোট ১০৫০ টাকা দিতে হয় চাঁদা (কালের কণ্ঠ, ৩০ নভেম্বর ২০২৪)।

কৃষি গবেষণায় বরাদ্ধ বৃদ্ধি : আধুনিক কৃষি নিবিড় গবেষণানির্ভর। নতুন নতুন উচ্চফলনশীল বীজ, লবণাক্ততা নিরোধক বীজ, কম-তৃষ্ণতা ফসল, ফসল পাকার সময় হ্রাস, পোকামাকড় নিরোধক ফসল, একই মৌসুমে একাধিক ফসলের চাষ অথবা একই ফসল একাধিক মৌসুমে উৎপাদন এবং উপকরণ সাশ্রয়ী ফসল ইত্যাদি উদ্ভাবনে কৃষি গবেষণাকেন্দ্রগুলোকে আরও শক্তিশালী করা হবে। জিএমও ফসল সম্পর্কে নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরিবেশবান্ধব ও জাতীয় কল্যাণমুখী নীতি গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্রীয় বাজেটের একটি যৌক্তিক অংশ কৃষি গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা হবে। হাঁস, মুরগি, মৎস্য, পশুসম্পদ, কৃষিজাত ফসল ও বন সম্পদ উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

কৃষি বিমা ও ঋণ : কৃষি নানা ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ে। এ ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্যবিমা, পশুবিমা, মৎস্যবিমা এবং পোলট্রি বিমা চালু করা হবে। গরিব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত কৃষকের ঋণের সুদ মওকুফ করা হবে।

সাবসিডি আওতা সম্প্রসারণ : ছাগল, গবাদি পশু ও মহিষের খামার গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তি খাতকে প্রণোদনা দেওয়া হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণে শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেওয়া হবে। কৃষি উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য হবে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান। সুষম, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি (ক্যালরি, আমিষ, ভিটামিন, মিনারেলস, ফ্যাট ইত্যাদি) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে গোটা কৃষি খাতকে পুনর্বিন্যাস ও বিকশিত করা হবে। কৃষিতে অনিরাপদ ও ক্ষতিকর সার ও কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করা হবে।

করোনার সময় পৃথিবীর অনেক দেশ খাদ্য নিরাপত্তায় চ্যালেঞ্জে পড়েছিল। আমাদের কৃষি ও কৃষকরা সে অনিশ্চিয়তায় ঢাল হিসাবে দাঁড়িয়েছিল। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে-এ সত্য প্রথম অনুধাবন করেছিলেন স্টেটসম্যান জিয়াউর রহমান। পতিত সরকার কৃষি ও কৃষককে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণি হিসাবে ট্রিট করেছিল বিধায় কৃষকের সার-বীজের দাম ও প্রাপ্যতা, সেচের পানি কিংবা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য জাতীয় সমস্যা হিসাবে গুরুত্ব দেয়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কৃষি ও কৃষককের ব্যাপারে ‘লুক ফরোওয়ার্ড’ নীতি বাস্তবায়ন করবেন।

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ : গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম