Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় ঐক্য

Icon

ব্রি. জে. (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় ঐক্য

শেষ পর্ব

ড. আকবর আলি খানের ‘Discovery of Bangladesh’ বইয়ের ১৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের মন্তব্যটাও আমাদের জানা জরুরি। তার উদ্ধৃতি দিয়ে ড. আকবর আলি খান লিখেছেন

Lawrence Ziring described Bangladesh as an anachronism within anachronism' which are just reactions to past mistakes and warrant that the real Bangladesh is yet to emerge.

সত্যিই তাই, এ কম পড়ুয়াদের দেশে কিছু ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ থাকবে এবং আসবে। যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার হাত ধরে ‘নতুন বাংলাদেশ’ হোক; পড়ুয়া, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ ও উদ্যমী তরুণরা তার হাতকে শক্তিশালী করুক, এটাই হোক প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, ঐক্যের হাত খুবই শক্তিশালী। আমি একজন স্বপ্নবিলাসী ও আশাবাদী মানুষ। আমি সবকিছুতে ইতিবাচকতা খুঁজতে পছন্দ করি। আমাদের ভুলগুলো সংশোধন করে নতুন করে পথ চলায় আমি বিশ্বাসী। কারণ উন্নয়নের প্রথম ধাপ হলো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। এ বিষয়ে সম্ভাবনার একটি বড় উদাহরণ মালয়েশিয়ার রূপকার ডা. মাহাথির মোহাম্মাদ। তার ‘এ ডক্টর ইন দ্য হাউজ’ বইয়ে তিনি লিখেছেন,

প্রথম তিনজন প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যেকেই ছিলেন লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত আইনজ্ঞ। আমি (ডা. মাহাথির) ছিলাম সিঙ্গাপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ ডাক্তার। ওটাই আমাকে অসুবিধায় ফেলেছিল। একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য সেরা যোগ্যতা হিসাবে মেডিসিনকে বিবেচনা করা হতো না। এ কাজে ঢ্যাঁড়া উপযুক্ত ছিলেন আইনজ্ঞরা, কারণ সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট ছিল আইনবিষয়ক কর্মকাণ্ড। মনে করা হতো, আইন ও প্রশাসনের জটিলতায় ডাক্তারদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই।

এ নিরিখে আমি বলব সব তরুণই-যিনি সুশিক্ষিত, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময়। তোমাদের ত্যাগ, অনুপ্রেরণা দেওয়ার ভাষা হোক বই এবং ইতিহাসকেন্দ্রিক। এ লেখার একটি বিষয় ছিল জাতীয় ঐক্য। এবার আসি এ বিষয়ে। ১৬ জানুযারি, ২০২৫ প্রথম আলো English-এ ড. ইউনূসের একটি খবর বার্তা সংস্থা বাসসের মাধ্যমে ‘Charter of New Bangladesh to be formed: Chief Adviser’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, a national commitment, not any partisan commitment, while all parties will sign up on it. অন্য একটি সূত্রমতে, জাতীয় ঐক্য বলতে একই জাতি বা দেশের লোকদের মধ্যে অভিন্ন পরিচয় এবং ভাগ করা মূল্যবোধকে বোঝায়। সামনের দিনগুলোতে আমরা যাই করি, তাতে সবাইকে ‘Moral High Ground’-এ দাঁড়াতে হবে। দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধীদের শাস্তি পেতেই হবে। তার অতিরিক্ত নয়। সন্তানকে সঠিকভাবে জানতে হবে তার বাবা/মা দেশের জনগণের অর্থ পাচার এবং দুর্নীতি করেছে। সন্তান যদি মেধাবী ও সুশিক্ষিত হয়, তাকেও ব্যবহার করতে হবে দেশের প্রয়োজনে। সব অপরাধীর ক্ষমা চাওয়া ও দেশের মানুষের কল্যাণে তাদের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। আমরা অনেক বড় অঙ্কের অর্থের পাচার এবং অঢেল সম্পদ লুটপাটের কথা শুনি। তাই যদি হয়, তবে তা শিক্ষা ও গবেষণায় ব্যয় করি না কেন? আমরা মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার মতো শুরুতে একটি লাইব্রেরি বানাতে পারি। যদিও এটি বিশ্বের প্রথম দশটি লাইব্রেরির তালিকায় নেই, তবুও মুসলিম দেশে ইতিহাস রক্ষার জন্য এটি অতুলনীয়। সূত্রমতে, বিশ্বের বড় লাইব্রেরি হলো ব্রিটিশ লাইব্রেরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি লাইব্রেরি ওয়াশিংটন ডিসি ও নিউইয়র্ক শহরে রয়েছে। চীন, কানাডা এবং রাশিয়ার লাইব্রেরিও শীর্ষ দশে আছে। কেন লাইব্রেরি আমাদের গড়া উচিত! সব লুটের অর্থ একসঙ্গে করে তার ইতিহাস অন্য পর্বে লিখব। কারণ এতে করে আমার বাবা, যিনি ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা জীবন বেছে নিয়েছেন, তার কথা লিখতে হবে। তবে আমাদের শিক্ষার মান যে খুব ভালো নেই এবং টেকসই নয়, তা আমি বলতে পারি। আমি আজই আমার বন্ধু কর্নেল জগলুল আহসানের ফেসবুক থেকে ব্যর্থ সমাজের একটি চিত্র পেলাম। তিনি রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ-এর উদ্বৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘ব্যর্থ সমাজের মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে জেগে উঠে না। সে জেগে উঠে স্লোগানে।’ ...‘ব্যর্থ সমাজের মানুষ ব্যর্থ হয় না। এখানে সচতুরভাবে ব্যর্থ বানানো হয়।’ আমার কোনো সন্দেহ নেই আমরা ব্যর্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছিলাম, ৩৬ জুলাই এ তরুণরা তা প্রথমবারের মতো বাধাগ্রস্ত করেছে। তোমরা (তরুণরা) একদিন ড. ইউনূসসহ আরও নতুন ইতিহাস হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ নামক দেশটি থাকবে। সবার মৃত্যু হবে।

আমাদের সৌভাগ্য, ড. ইউনূসের মতো একজন গুণী ব্যক্তি রাষ্ট্রের হাল ধরেছেন। আমাদের দেশ ছোট ও মানুষ বেশি। সেজন্য আমাদের অনেক ড. ইউনূস-তরুণ ড. ইউনূস দরকার। তা হবে বই পড়লে। স্লোগানের ভাষা গবেষণা থেকে উৎপত্তি হলে তা সফল হবেই। আমাদের তরুণ সমাজের অনেকেই ভালো বই লিখে রাষ্ট্রের মূল্যায়ন করতে পারে। বই মানুষকে নির্লোভ ও নিরহংকার করে, মহৎ করে। বই পড়ুয়ারা ঘৃণা ছড়ায় না। ঘৃণার পক্ষে বলে না বলে পড়ুয়াদের মধ্যে ঐক্য হলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। এ জাতির ঐক্যের বড় বাধা হচ্ছে অর্থ এবং ক্ষমতার দম্ভ। ছোটবেলায় আমরা বিতর্ক করেছি। জ্ঞান, যুক্তি ও তর্কে/ভাষায় বিপক্ষকে সুরুচিশীল ভাষায় আক্রমণ করেছি। বিতর্ক শেষে একই ডাইনিং হলে খেয়েছি, একই মাঠে খেলেছি। একই দলে। কিন্তু বিবাদ বা শারীরিক আক্রমণে লিপ্ত হয়নি। চলুন সে দিনটি ফিরিয়ে আনি। একটি মানুষের সবটুকু ভালো বা মন্দ থাকবে না। যেটুকু ভালো তা ব্যবহার করি; যা মন্দ তা উল্লেখ করে এড়িয়ে যাই-এগিয়ে যাই। মাথা দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাথাব্যথা হলে ওষুধ খেতে হয়। পুরো মাথা কাটা বোকামি। এ দেশের ১৮ কোটি মাথা আছে। ভাষা, বই ও কাজ দিয়ে ১৮ কোটিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারাই আমাদের সাফল্য। চলুন আমরা সঠিক ও পর্যাপ্ত ওষুধ খুঁজি। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ নামক একটি দেশ থাকবে। সবার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর পর আমাদের প্রজন্ম জানবে আমি, আমরা সবাই কী ছিলাম। সৎ, ত্যাগী, নাকি অসৎ, স্বার্থপর। (শেষ)

ব্রি. জে. (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও গবেষক

Jamuna Electronics

img img
Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম