যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন খনিজ চুক্তির নেপথ্যে

টেড স্নাইডার
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণত যে দেশ আপনাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছে, যুদ্ধের পর সেই দেশই লুটপাট করে, রক্ষাকারী দেশটি কিন্তু নয়। দুর্ভাগ্যবশত ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন একটি খনিজ চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ফলে ইউক্রেনের বৃহত্তম সামরিক রক্ষক এখন দেশটির সম্পদ লুটপাট করতে প্রস্তুত। চুক্তির আগে ট্রাম্প সতর্ক করেছিলেন, এতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে ইউক্রেনের জন্য ‘অনেক সমস্যা’ হবে।
যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জেলেনস্কি ইউক্রেনের বিজয় পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন, তখন তিনি একটি নতুন ধারণা তুলে ধরেন : ইউক্রেনের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সুরক্ষায় যৌথভাবে কাজ করবে। স্থায়ী ও বৃদ্ধি পাওয়া সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে ইউক্রেন প্রাকৃতিক সম্পদে যুগ্ম বিনিয়োগ এবং ব্যবহারের অনুমতি দেবে। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউক্রেনের লক্ষ্য ছিল ট্রাম্পকে বোঝানো যে, ইউক্রেন একটি দানখানা নয় বরং একটি খরচ-সাশ্রয়ী অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সুযোগ, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত করবে। কিন্তু জেলেনস্কির দলের কৌশলটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তারা হয়তো ভাবেনি, ট্রাম্প চুক্তির বিষয়ে সবসময় উঁচুতে থাকতে পছন্দ করেন।
প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার কৌশলটি সূক্ষ্ম হলেও দেশটির ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ছিল, যা ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে। জেলেনস্কি এখন তাদের নিজেদের ফাঁদেই ধরা পড়েছেন। ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেওয়ার গ্যারান্টি ছাড়াই ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদকে অতীতের সামরিক সহায়তার পরিশোধ হিসাবে দাবি করেন। তিনি দাবি করেছিলেন ইউক্রেনের বিরল মাটি ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের অর্ধেক, যতক্ষণ না ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়া হয়।
যদিও জেলেনস্কি ক্ষুব্ধ হয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু এই প্রত্যাখ্যান ট্রাম্পকে আরও রাগিয়ে তোলে। তিনি যুদ্ধ শুরু করায় জেলেনস্কিকে বিষাক্ত ডিকটেটর বলে আক্রমণ করেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি এই মানুষটিকে বছরের পর বছর দেখছি, যখন তার শহরগুলো ধ্বংস হচ্ছে, তার মানুষ মারা যাচ্ছে, সৈন্যরা নিধন হচ্ছে। আমি বছরের পর বছর দেখছি এবং আমি তাকে কার্ড ছাড়া আলোচনা করতে দেখছি। তিনি জুয়া খেলছেন; কিন্তু তার কাছে কোনো কার্ড নেই।’ ট্রাম্পের বক্তব্য হচ্ছে, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করাতে রাজি করিয়েছে একটি অজেয় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য।
যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথমদিকে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চাইছিল; কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জেলেনস্কিকে এই বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, কিয়েভ যদি মস্কোর সঙ্গে আলোচনা বাতিল করে লড়াইয়ে রাজি হয়, তাহলে যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ সামরিক ও আর্থিক সহায়তা তিনি পাবেন। এটাও ঠিক, ট্রাম্প একতরফাভাবে দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি পরিবর্তন করছেন। অন্যদিকে জেলেনস্কিও যা বলছেন তা সঠিক। জেলেনস্কি বলছেন, ইউক্রেনকে মার্কিন সাহায্য পরিশোধের জন্য তার প্রাকৃতিক সম্পদগুলো অর্পণ করতে হবে না। কারণ এসব সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র অনুদান হিসাবে দিয়েছিল, ঋণ হিসাবে নয়; আর অনুদান কখনো পরিশোধ করতে হয় না। কাজেই এ অনুদানকে ঋণ হিসাবে উল্লেখ করা উচিত নয়। কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, তার সঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইজেনের চুক্তি হয়েছিল এবং তৎকালীন মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে চুক্তি ছিল। জেলেনস্কি এছাড়াও অভিযোগ করেছেন, যে পরিমাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলছেন, তা সঠিক নয়।
ইউক্রেন প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করার পর ট্রাম্প প্রশাসন কিয়েভের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেয়। তাদের বলা হয়, ‘কম কথা বলো, পরিস্থিতি ভালোভাবে বিবেচনা করো এবং ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করো।’ এরপর তারা একটি সংশোধিত প্রস্তাব নিয়ে ফিরে আসে। অবশ্য এতেও ইউক্রেনের উদ্বেগ কমানোর মতো দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন ছিল না। নিউইয়র্ক টাইমস, যারা সংশোধিত প্রস্তাবটি দেখেছে, তারা জানায়, এতেও ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন খনিজ, গ্যাস ও তেল থেকে অর্জিত আয়ের অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হবে। পাশাপাশি বন্দর এবং অন্যান্য অবকাঠামো থেকে অর্জিত আয়ও। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি প্রদানের কথা এখানে উল্লেখ নেই। স্বাভাবিকভাবেই জেলেনস্কি এবারও এতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন।
ইউক্রেনের কাছে আসলে কী পরিমাণ খনিজ রয়েছে এবং এর প্রকৃত মূল্য কত, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া সিভরিদেঙ্কো স্বীকার করেছেন, ইউক্রেনকে তার ভূতাত্ত্বিক জরিপ আপডেট করতে হবে এবং মূল্যবান খনিজগুলোর সত্যিকারের মূল্য নির্ধারণ করার জন্য আরও অনেক অনুসন্ধান বাকি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যথাযথভাবে বিবেচনা না করলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হচ্ছে, ইউক্রেনের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের কোনো চিন্তা ‘অবাস্তব ও বিভ্রান্তিকর’, যা ট্রাম্পের কর্মকর্তারা স্বীকারও করেছেন। ইউক্রেনের যে খনিজসম্পদ রয়েছে, এর প্রায় অর্ধেকই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের নিচে রয়েছে।
সংশোধিত চুক্তিতে কিয়েভ কেবল একটি বিষয়ে বিজয় দাবি করতে পারে। সেটা ৫০০ বিলিয়ন ডলারের দাবি প্রত্যাহার। তবে এটি ইউক্রেনের জন্য কিছুটা সান্ত্বনা মাত্র। কারণ খসড়ায় এখনো ইউক্রেনের আয়ের অর্ধেকের বিষয়টি রয়েছে এবং এর বিনিময়ে মার্কিনিদের নিরাপত্তা গ্যারান্টির কোনো উল্লেখ নেই। ফলে এটি হলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের লুটের শিকার হবে ইউক্রেনের জনগণ। কারণ রাজস্বের একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাবে, যা দিয়ে ইউক্রেন তার অর্থনীতি পুনর্গঠন ছাড়াও প্রতিরক্ষা ও জাতি পুনর্গঠনে ব্যয় করতে পারতো।
অ্যান্টিওয়ারডটকম থেকে ভাষান্তরিত
টেড স্নাইডার : মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাসবিষয়ক কলামিস্ট

