বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় ঐক্য

ব্রি. জে. (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
৫ আগস্ট, ২০২৪ অথবা ৩৬ জুলাই আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে, যেখানে তরুণদের ভূমিকা, ত্যাগ ও সাহস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ৩৬ জুলাই নামক বিশেষ দিনটি নতুন তারিখ চিহ্নিত করাসহ গবেষকদের নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আমাদের ইতিহাস রক্ষণার্থে এ প্রয়াস একদিন অনেক বাস্তবতার সাক্ষ্য দেবে। আমি যখন একজন নাগরিক হিসাবে রাস্তা দিয়ে, বিশেষ করে কোনো বিদ্যাপীঠের পাশ দিয়ে হাঁটি এবং নজর দিই, তখন আমি বিস্মিত হই তরুণদের ‘নতুন বাংলাদেশ’ নিয়ে ভাবনা দেখে। আমরা যারা তাদের থেকে বয়সে অনেক বড়, তারা কিন্তু অনেকেই কখনো ভাবিনি ৫ আগস্ট, ২০২৪ বা ৩৬ জুলাই এ দেশে এমন কিছু ঘটে যাবে বা যাচ্ছে। আমার কন্যাসন্তানটিও আমাদের ভুল ধরিয়েছে। যেহেতু আমি চাকরিরত এবং সেনানিবাসে সুশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত, আমার সন্তানের নৈতিক অবস্থান আমাকে কখনো ভাবিয়েছে, কখনো গর্বিত করেছে। পরিস্থিতি এমনভাবে অগ্রসর হলো, কীভাবে যেন আমি ৩ আগস্টের সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের সবার উদ্দেশে আলোচনার চিঠি আমার ছোট মেয়ের ফেসবুক বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে পেলাম; যা হোক, অপরাধ বা সঠিক যাই বলি না কেন, জনগণের কাছে ক্ষণিকের মধ্যেই সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, মহানুভব ফসল-‘ছাত্রদের বুকে গুলি নয়’ খবরটি বিশ্বের সব স্থানে পৌঁছে গেল। বাংলাদেশ প্রবেশ করল নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার পথে। আমাদের মতো পেশাদারদের শুরু হলো নতুনভাবে লেখাপড়া, গবেষণা ও লেখার উদ্যোগ।
শুরুতেই আমার কৃতজ্ঞতা জুলাই বিপ্লবের সব শহিদ ও আহত তরুণ যোদ্ধাদের। তারপর সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতি, যিনি একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি থেকে দেশমাতাকে রক্ষা করেছেন। সেইসঙ্গে আমি কৃতজ্ঞ জনাব পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, কনক সারোয়ার, লে. কর্নেল মুস্তাফিজসহ অন্য সব বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক, যারা বিভিন্ন তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে জাতিকে আলোকিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তবে তাদের জানার ও বিশ্লেষণে ভুল থাকতে পারে, যা আমাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। অনেকের মতে, অনেক কিছু মিথ্যা, মনগড়া ও অতিরঞ্জন হতে পারে, কিন্তু আমাদের মানতেই হবে তারা দেশকে ভালোবাসেন এবং তারা দেশের ভেতরে থেকে জীবন-জীবিকার জন্য ঝুঁকি না নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। বাদ পড়ে গিয়েছিল জনাব জুলকারনাইন সায়েরের কথা উল্লেখ করতে। সম্প্রতি ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও অন্যান্য মাধ্যমের কারণে নতুন প্রজন্মের কথা বলা ও চলার ভাষার পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম লেখায় এ বিষয়ে মন্তব্য করছি না। কারণ আমার বিশ্লেষণের বিষয় ভিন্ন এবং ভাষা ও বইকেন্দ্রিক। এ লেখায় তা না লিখলে আমার মনে হবে ‘আমি তো বলে যেতে পারিনি’। তাছাড়া কে জানে কখন কোন বাংলাদেশি, কোন নাগরিক এমন কিছু মন্তব্য করলেন, যা থেকে লেখার অনুপ্রেরণা দেওয়া তো দূরে থাক, অভিমানে লেখা বন্ধ করে দিতে হলো। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি ভয়ানক। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই, কিছুদিন আগে আমার বেশ ক’জন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো, যারা অনেক আগেই অবসরে গিয়েছেন। চাকরিরত অবস্থায় তাদের কর্মস্থল ছিল আলোকিত, তাদের জ্ঞান বিতরণের ইচ্ছা ও মান ছিল প্রশংসনীয় ও ঈর্ষণীয়। কিন্তু তাদের আমরা (অধীনস্থরা) আমাদের কাঙ্ক্ষিত ও স্বপ্নের স্থানে দেখতে পাইনি। সেজন্য তাদের মনে হয় অভিমান আছে। এ বিষয়টি আমাদের যত সম্ভব ত্বরিত অনুধাবন করা যাবে, তত জাতির মঙ্গল হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা জাতীয় ঐক্যের বড় অন্তরায় ছিল। বাঙালির ঐক্য বিনষ্ট হলে তৃতীয় পক্ষ লাভবান হবে, তা আমাদের জানা দরকার।
এবার আসা যাক কিছু তাত্ত্বিক বিষয়ে, কেন ও কীভাবে বাংলাদেশে ৩৬ জুলাই নামক একটি ‘বিশেষ দিন’-এর সৃষ্টি হলো। বিখ্যাত মার্কিন লেখক স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ‘The Soldier and The State’ বইটি প্রত্যেক সৈনিকের (অফিসারের) পড়া উচিত ছিল এবং থাকবে। এ বইয়ের Chapter 6-এ ‘The Ideological Constant: The Liberal Society versus Military Professionalism’-এর বিষয়গুলো আমাদের জানা উচিত। যদিও মার্কিন Civil-military Relations-এর ইতিহাস থেকে উদ্ধৃত, তবুও আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মিল রয়েছে। এ বইয়ে বলা আছে, Liberalism is divided in its views on war but it is united in its hostility to the military Profession. The function of this profession is the military security of state, and legitimacy of this concern is recognized by neither Crusader nor Pacifist. Both see the Military profession as an obstacle to the achievement of their own aims. The pacifist views the professional military man as a warmonger, plotting to bring about conflicts so as to enhance his own rank and power. The crusader views the professional soldier as a sinister drag upon the conduct of war, uninterested and unaroused the ideals for which the war is fought. The pacifist sees the military contaminating his peace, the crusader sees him contaminating his crusade.
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মান যাই হোক না কেন, সমাজে পর্যাপ্ত লিবারেলিজমের (উদারনীতিবাদ) ছোঁয়া রয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার নেই। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ শান্তিপ্রিয় ও খেটে খেয়ে নিজের যোগ্যতার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে এবং করতে চায়। তারা কোনো সহিংসতা ও নির্মমতা চায় না। তাদের অনেকেই নিরপেক্ষ ও নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। তারা অন্যায় করে না ও অন্যকে অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য প্রতিবাদ, নীরব প্রতিবাদ ও ঘৃণা করে। অনেকেই অন্যায়কারীদের ক্ষমতা, দম্ভ এবং বেপরোয়া আচরণকে কখনো ভয় পায় এবং যেজন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখে। আবার কখনো আরও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদী হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে আমরা সবসময়েই ‘প্রবল শোষণকারী’দের কার্যক্রম লক্ষ করেছি। তারা পরিবর্তনের নামে নিজস্ব দলের মানুষ, নেতাকে মহামানবে পরিণত করে জনসাধারণের অর্থ ও সম্পদ নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। তাদের চরিত্র ক্রুসেডারদের মতো। বাংলাদেশে ক্রুসেডারদের মতো মানুষের মুখের ভাষায় দাম্ভিকতা সবসময় দেখা গেছে। অন্যকে খাটো করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার বিষয়টি প্রকটভাবে লক্ষ করা গেছে। (পরবর্তী পর্ব আগামীকাল)
ব্রি. জে. (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও গবেষক