সংস্কারে ঐকমত্যের ফানুস

মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ও ছয়টি কমিশনের প্রধানগণের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। এ ঐকমত্য কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ করবে। ঐকমত্য কমিশন এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
কমিশনগুলোর প্রতিবেদন সাধারণ পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, কতিপয় ক্ষেত্রে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন কমিশন ভিন্ন ভিন্ন সুপারিশ করেছে। কমিশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে হয়। এছাড়াও কমিশনগুলোর কতিপয় সুপারিশেও রয়েছে অস্পষ্টতা, অসংগতি এবং বাস্তবায়ন অযোগ্যতা। এক কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে অন্য কমিশনের সুপারিশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এবং কোনো কোনো কমিশনের সুপারিশে অস্পষ্টতা ও অসংগতি থাকায় তা বাস্তবায়ন পর্যায়ে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া এসব অস্পষ্টতা এবং অসংগতি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সুপারিশ রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য সৃষ্টিতে অন্তরায় হতে পারে।
সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই। এরূপ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশনের উচিত হবে, সব কমিশনের সুপারিশগুলো একত্রে পর্যালোচনাপূর্বক যেসব সুপারিশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যেসব সুপারিশে অস্পষ্টতা ও অসংগতি রয়েছে, তা দূর করা। এছাড়া বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, এমন সুপারিশগুলো বাদ দেওয়া বা পরিবর্তন করা এবং রাষ্ট্রের ও জনস্বার্থের অনুকূল সুপারিশগুলো বাছাই করে বাছাইকৃত সুপারিশ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর প্রতি ঐকমত্যের আহ্বান জানানো।
কমিশনগুলোর সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি ও অসামঞ্জস্য রয়েছে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ বিষয়ে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ এবং রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা হিসাবে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে। সুপারিশটি অনেকটা অসম্পূর্ণ ও দায়সারা সুপারিশ বলে মনে হয়েছে। এ প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা অন্য কোনো দেশের মডেলের হবে, নাকি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা মডেল হবে, সে সম্পর্কে সুপারিশে কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা এবং প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক কাঠামোগত বিস্তর ফারাক রয়েছে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর জন্য সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশিব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু অন্যান্য কমিশন তাদের সুপারিশ বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার আদলে করেছে। এ অবস্থায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ গ্রহণ করা হলে সংবিধান সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। এমনকি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অন্যান্য সুপারিশেও পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া সংবিধান সংস্কার কমিশন দেশের সব বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। কিন্তু প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক প্রদেশে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশন কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা চায়, তা স্থির না করে এবং প্রয়োজনে তদনুযায়ী সব কমিশনের সুপারিশে সামঞ্জস্যবিধান না করে রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে ঐকমত্যের আহ্বান জানানো কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া পরস্পরবিরোধী সুপারিশের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোরও বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যা ঐকমত্যে পৌঁছতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দুদককে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণার সুপারিশ করেছে। অপরদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন দুদককে সাংবিধানিক কমিশন করার সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন দুদককে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নাকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখতে চায়, তা নির্ধারণ করে রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে। এছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আট সদস্যবিশিষ্ট তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। অপরদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন চার সদস্যবিশিষ্ট একটি সরকারি কর্ম কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এনসিসির মনোনয়নে দুদক কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করেছে। অথচ দুদক সংস্কার কমিশন ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’র মনোনয়নে কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করেছে। উপরন্তু দুদক সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করেছে, যা সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া দুদক কমিশন সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পালকে জাতীয় কৌশলপত্র প্রতিপালনের জন্য ক্ষমতায়িত করার সুপারিশ করেছে, যা সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অপরদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ন্যায়পালের অতিরিক্ত একটি প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার নিয়োগের ক্ষেত্রে পৃথক শারীরিক যোগ্যতা অন্তর্ভুক্ত করে আবেদনের যোগ্যতা নিরূপণের সুপারিশ করেছে। সেই সঙ্গে সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা সাংবিধানিক কাঠামোভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশ কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করেছে। কিন্তু সংবিধান সংস্কার কমিশন পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করেনি।
জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নিবন্ধন অধিদপ্তর এবং বিবাহ নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যাদি আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখার সুপারিশ করেছে। অপরদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিবন্ধন অধিদপ্তরকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং বিবাহ নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যাদি জেলা প্রশাসকের অধীনে রাখার সুপারিশ করেছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিদ্যমান পুলিশ সার্ভিস থেকে পৃথক একটি ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করেছে। অপরদিকে পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কেবল একটি পুলিশ সার্ভিসেরই সুপারিশ করেছে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সুপারিশগুলোও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দুদক সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক ও নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনি আইনে সংস্কার আনার সুপারিশ করেছে, যা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নেই। এক কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে অন্য কমিশনের সুপারিশে এমন আরও অনেক অসামঞ্জস্য ও অসংগতি রয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে ঐকমত্যের আলোচনার আগে সব কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন প্রয়োজন হবে।
সংস্কার কমিশনগুলোর কতিপয় সুপারিশ নিয়ে ইতোমধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কাঠামো পরিবর্তন সংক্রান্ত সুপারিশ। এ সুপারিশের এক অনুচ্ছেদের সঙ্গে অন্য অনুচ্ছেদের মারাত্মক অসংগতি রয়েছে। এছাড়া সুপারিশে আন্তঃসার্ভিস অসমতা দূর করার কথা বলা হলেও আন্তঃসার্ভিস অসমতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে হয়। সুপারিশ অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের পদ যদি সব ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তাহলে মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের উচ্চতর লাইন পোস্ট বলে তো কিছুই থাকবে না। এছাড়া প্রশাসন সার্ভিসের মাঠ পর্যায়ের লাইন পোস্টে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের সদস্যদের পদায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক সরকার মাঠ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রশাসন সার্ভিসের শতভাগ লাইন পোস্টেই (যেমন, জেলা প্রশাসক পদে) সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের সদস্যদের পদায়ন করতে পারবে। যদি তাই হয়, তাহলে প্রশাসন সার্ভিসের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হবে, সেটা ভেবে দেখা উচিত। মনে রাখতে হবে-দক্ষ, যোগ্য ও শক্তিশালী প্রশাসন সার্ভিস ছাড়া কোনোভাবেই সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, অন্যান্য সার্ভিসের লাইন পোস্টে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের সদস্যদের পদায়নের কোনো সুপারিশ করা হয়নি। এরূপ বৈষম্যমূলক সুপারিশ অসমতা দূর করার নজির হতে পারে না।
বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সব সদস্যের সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কেবল সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী দাখিলের সুপারিশ করেছে। এতে করে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদ গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ার অন্তরায়। এছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী জনগণের কাছে প্রদর্শনের ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে। সম্পদ বিবরণী নেওয়া হয় ব্যক্তির জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে আহরিত সম্পদ সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ার ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে, জনগণকে জ্ঞাত করার উদ্দেশ্যে নয়। এটা জনসম্মুখে প্রকাশে বাধ্য করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। সুপারিশ বাস্তবায়নের আগে এ দিকগুলোও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, সংস্কার প্রস্তাবের দুর্বলতার দমকা বাতাসে যেন সংস্কারের ফানুস অদৃশ্য হয়ে না যায়।
মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ