
ছবি: সংগৃহীত
আরব নেতারা আগামী সপ্তাহে কায়রোয় আরব লীগের জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ অঞ্চলের পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এই জরুরি বৈঠক। গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসন থেকে শুরু করে লোহিত সাগরে বাড়তে থাকা উত্তেজনা, পরিবর্তিত বৈশ্বিক জোট এবং স্থায়ী অর্থনৈতিক দুর্বলতা-এসব কারণে আরব বিশ্ব একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে এ মুহূর্তটি মৌখিক ঐক্যের চেয়ে বেশি কিছু দাবি করে। এটি করণীয়, কৌশলগত সমন্বয় এবং অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলোর সাহসী পুনর্মূল্যায়ন দাবি করে।
গাজা যুদ্ধের পর আবারও আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষোভকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণে পরিণত করার ক্ষেত্রে অক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। নিন্দার বিবৃতি ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও তা ইসরাইলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ফিলিস্তিনে যে মানবিক বিপর্যয় প্রকাশ পেয়েছে, তা কেবল উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত নয়, বরং আরব বিশ্বের একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
একই সময়ে লোহিত সাগরের উত্তেজনা-যেখানে হুতি গোষ্ঠী বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা করেছে এবং পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে-তা আরব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য সরাসরি হুমকি তৈরি করছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথে সামরিকীকরণ বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মাঝে বিস্তৃত কৌশলগত প্রতিযোগিতা একটি আরব নিরাপত্তা কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বিদেশি প্রভাবের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তিত জোটগুলো একটি বিকাশমান বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। আব্রাহাম চুক্তি, কিছু আঞ্চলিক সংঘাত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা এবং উপসাগরীয় এলাকায় চীনের বাড়তে থাকা উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে আরব বিশ্বকে তার পররাষ্ট্রনীতির কৌশলগুলো পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এই পরিবর্তনগুলোর প্রতি নিষ্ক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর পরিবর্তে আরব দেশগুলোকে তাদের সমষ্টিগত প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে কৌশলগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
অর্থনৈতিক বিভাজন দীর্ঘকাল ধরে একটি দুর্বলতা হিসাবে কাজ করেছে, যা এ অঞ্চলকে বাইরের চাপের প্রতি সংবেদনশীল করে রেখেছে। আরব দেশগুলোর জন্য এখন সময় এসেছে কেবল আলোচনার পরিবর্তে অর্থনৈতিক সংহতির বিষয়ে স্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার। জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে একটি একক কৌশল বিশ্ববাজারের ওঠানামা এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের বিশাল জ্বালানি সম্পদ নিয়ে একটি স্বাধীন আরব জ্বালানি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে, যা আঞ্চলিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং পশ্চিমা বাজারের ওপর নির্ভরতা কমাবে। একইসঙ্গে কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং আন্তঃআরব বাণিজ্য এ অঞ্চলকে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হতে পারে, যা দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতার একটি উৎস।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল অর্থনীতির দ্রুত অগ্রগতি আরব দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সহযোগিতার আরেকটি সুযোগ তৈরি করেছে। বিদেশি অংশীদারত্বের জন্য পৃথকভাবে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে আরব দেশগুলোকে একটি আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্র, উদ্ভাবন তহবিল এবং সহযোগিতামূলক চুক্তি গড়ে তুলতে হবে, যা তাদের জন্য একটি স্বনির্ভর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হলে তা কেবল সমষ্টিগত সমৃদ্ধি ঘটাবে না, বরং বৈশ্বিক মঞ্চে তাদের রাজনৈতিক প্রভাবও বাড়াবে।
দশকের পর দশক ধরে আরব শীর্ষ সম্মেলনগুলো ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে; তবে এই বিবৃতিগুলো অর্থপূর্ণ কাজে পরিণত হয়নি। গাজায় ইসরাইলি বোমাবর্ষণ এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনের সম্প্রসারণ মৌখিক কথার চেয়ে বেশি কিছু দাবি করে-এমন নীতির পরিবর্তন দাবি করে, যা ইসরাইলের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করবে। একটি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হতে পারে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে না চললে স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিগুলো স্থগিতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ। এছাড়া আরব দেশগুলোকে তাদের প্রভাব ব্যবহার করতে হবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে, যেমন জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে, যাতে ইসরাইলকে তার যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায়।
আরব বিশ্বকে পশ্চিমা মধ্যস্থতার ওপর নির্ভরতার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে, যা ক্রমাগতভাবে ইসরাইলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। একটি শক্তিশালী আরব-নেতৃত্বাধীন শান্তি উদ্যোগ, যা ফিলিস্তিনিদের আকাঙ্ক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, তা অতীতের ব্যর্থ কাঠামোর বিকল্প হিসাবে অনুসরণ করা উচিত। একটি স্পষ্ট ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যুটি ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিভক্তির এই বিশ্বে একটি অবহেলিত বিষয় হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কাজেই আসন্ন আরব শীর্ষ সম্মেলন কেবল একটি কূটনৈতিক সমাবেশ নয়, আরব নেতারা এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম কিনা, এটি তার একটি পরীক্ষা। এ অঞ্চলে প্রয়োজনীয় সম্পদ, কৌশলগত সুবিধা এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রয়েছে, যাতে এটি একটি একক ও প্রভাবশালী ব্লক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তবে এটি কেবল তখনই অর্জিত হবে, যখন নেতারা সমষ্টিগত স্বার্থকে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার উপরে অগ্রাধিকার দেবেন, শূন্য বিবৃতির পরিবর্তে নির্ধারক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবেন এবং এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন, যা এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে সুরক্ষিত করবে।
একটি বিভক্ত আরব বিশ্ব হলো একটি দুর্বল আরব বিশ্ব। ঐক্য, কৌশল ও সক্রিয় হওয়ার সময় এখনই।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
হানি হাজাইমেহ : আরব নিউজের আম্মানভিত্তিক সিনিয়র সম্পাদক

