Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মিঠে কড়া সংলাপ

সংকট উত্তরণে যা করণীয়

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংকট উত্তরণে যা করণীয়

ছবি: সংগৃহীত

দেশের বর্তমান অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ একটি মন্ত্রিসভার জাতীয় সরকার দ্বারা শক্তভাবে দেশ পরিচালনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে দিনের পর দিন রাজপথ অবরোধ করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা নিছক দাবি-দাওয়া আদায়ের ঘটনা না-ও হতে পারে; ক্ষেত্রবিশেষে সেসবের কোনো কোনোটি সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার ঘটনাও হতে পারে।

আবার দেশের বাইরেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে, দেশের বিরুদ্ধে স্পষ্টত যা একেকটি ষড়যন্ত্র। এ অবস্থায় অত্যন্ত দক্ষ এবং শক্তিশালী একটি কূটনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এতদিন ধরে ভারতীয় মিডিয়া দিনরাত গালগল্প প্রচার করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রেখে তেমন কোনো সুবিধা করতে না পারায় বহির্বিশ্বে এখন তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে।

যেমন অতি সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠককালীন ভারতীয় একজন সাংবাদিক অপ্রাসঙ্গিক এবং উসকানিমূলক একটি প্রশ্ন তুলে ট্রাম্পকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন, যে প্রশ্নটি সারা বিশ্বে ভাইরাল হয়ে এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বিষয়ে এমন একটি আপত্তিজনক প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ ছিল না।

যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প সেদিন অত্যন্ত কৌশলে প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে সাংবাদিকের সেই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে যা বলেছিলেন, সে ঘটনাটিও প্রশ্নকর্তার জন্য লজ্জাজনক বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘তিনি পড়াশোনা করে যা বুঝেছেন, তাতে এ প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন বিধায় তার ওপরই বিষয়টি ছেড়ে দিলাম; কারণ শত বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কাজ করে চলেছেন।’

উল্লেখ্য, ট্রাম্পের সেই বক্তব্যের পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আঁচ করতে পেরে জবাবে তিনি কোনো কিছু না বলে প্রসঙ্গ পালটিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছিলেন। কারণ মোদির মতো বিচক্ষণ ব্যক্তি, যিনি ভারতীয় কংগ্রেসের মতো একটি রাজনৈতিক দলকে পরাজিত করে বারবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার খোঁচাটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আর ‘এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শত বছর ধরে কাজ করে চলেছেন’ কথাটি বলার মর্মার্থ সেদিনের প্রশ্নকারী ভারতীয় সাংবাদিক না বুঝলেও সারা বিশ্বের বুদ্ধিমান মানুষ কিন্তু ট্রাম্পের মেসেজটি বুঝতে পেরেছেন। কারণ মাথায় একটু মগজ থাকলেই মেসেজটি সবারই বুঝতে পারার কথা।

তারপরও যদি ওই শ্রেণির সাংবাদিকরা তা বুঝতে না পারেন, তাহলে সহজভাবে তারা বুঝে নিন, ট্রাম্প সেদিন, প্রশ্নটির গুরুত্ব না দিয়ে বরং বিরক্তির সুরে বলেছিলেন, ‘সারাজীবন পড়াশোনা করে তিনি বুঝতে পেরেছেন, শত বছর ধরে ভারত কাশ্মীরসহ পাকিস্তানের সঙ্গে যেমন সমস্যা তৈরি করে রেখেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গেও তারা সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে।’

হ্যাঁ, ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুরা, আমি বা আমরা ট্রাম্পের কথাটি এভাবেই ব্যাখা করতে চাই। আর সে কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেদিন পুরো প্রসঙ্গটাই বিচক্ষণতার সঙ্গে ঘুরিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নটিকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছিলেন। অথচ কলকাতায় বসে অনেকে আবার একই বিষয়ে গলা ফাটিয়ে বলছেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন; তাদের মতে, এখন থেকে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে চাইবেন, বাংলাদেশকে সেভাবেই চলতে হবে!’ আর এভাবে দাদাগিরি ফলানোর সহজ একটি সমীকরণ কষে দাদাবাবুরা টেলিভিশনের পর্দায় সমানতালে বগল বাজিয়ে চলেছেন।

এ অবস্থায় বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ বর্তমান সরকার যেহেতু কোনো রাজনৈতিক শক্তিশালী সরকার নয়, বা পূর্ণাঙ্গ সরকারও নয়, সে অবস্থায় কিছুটা হলেও দুর্বলভাবে সরকার পরিচালিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত একটি সরকারের সঙ্গে অবশ্যই বর্তমান সরকারের গুণগত একটি পার্থক্য আছে। যদিও একটি সুষ্ঠু ও সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বর্তমান সরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করে চলেছে, কিন্তু সে কাজটি করার আগেই দেশি-বিদেশি শত্রুরা কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে যায় কিনা, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন।

কারণ সারা দেশে বাড়িঘর ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি ঘটনায় কিছুটা হলেও সরকার ব্যাকফুটে চলে গেছে এবং যাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়েছে, কিছুটা হলেও মানুষের সহানভূতি তাদের পক্ষে চলে গেছে। এ অবস্থায় এসব ভাঙচুর, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধ করার ব্যর্থতাও যে সরকারের ঘাড়ে চেপে বসেছে, সে কথাটি উল্লেখ না করলেও চলে। আর দেশে একটি সরকার বিদ্যমান থাকা অবস্থায়, এমন অরাজকতা যে চলতে পারে না বা চলতে দেওয়া উচিত নয়, জনান্তিকে সে কথাটিও সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ না থাকলেও বাংলাদেশের মতো সমস্যা জর্জরিত একটি দেশ পরিচালনায় কয়েক উপদেষ্টার শক্তি-সামর্থ্যরে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন থেকেই যায়। একটি কঠিন কাজ এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কর্মস্পৃহাকে সম্মান জানিয়ে বলতে চাই, ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি প্রতিকূলতা, অনেক বেশি দেশি-বিদেশি শত্রুতা মোকাবিলা করে সামনের পথগুলো অতিক্রম করতে হবে। কারণ শেখ হাসিনার পতনে ভারত খুশি নয় বিধায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি। সুতরাং ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা তাদের ক্রিয়াকর্ম যে অব্যাহত রাখবেন, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।

আর ভারত সরকারও যে তাদের সেসব কাজে বাদ সাধবে না, সে বিষয়টিও নিশ্চিত। তাছাড়া হাতে টাকা থাকলে বড় বড় লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমেও বিতাড়িত সরকারের লোকজন তাদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারবেন। সে অবস্থায় একটি শক্তিশালী বড় আকারের রাজনৈতিক শক্তি বা দল দ্বারা দেশ পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। এমনকি ভারতীয় আধিপত্যবাদকে মোকাবিলা করতে সামনের দিনে একক কোনো রাজনৈতিক দল দ্বারা দেশ পরিচালনাও বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়; একটি সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত বহুদলীয় একটি জাতীয় সরকারের অধীনে অন্তত আগামী পাঁচ বছর সরকার পরিচালিত হলে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়। কারণ এখন থেকেই সামনের দিকের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার জন্য সম্মিলিত রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতে তার খেসারত দিতে হতে পারে।

এক্ষেত্রে আবারও স্মরণ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বলছি, দেশি-বিদেশি শত্রুদের দুর্বল ভাবলে কিন্তু ভুল করা হবে। কারণ তাদের হাতে যেহেতু প্রচুর অর্থ আছে, সুতরাং সেসব অর্থ খরচ করে প্রয়োজনে তারা নিজের নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গের মতো ঘটনা ঘটাতেও কসুর করবেন না। আর বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে তাদের পক্ষে দূতিয়ালি করার মতো লোকেরও কিন্তু অভাব হবে না, যেভাবে নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উসকানিমূলক প্রশ্নটি করা হয়েছিল।

তাছাড়া দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনা আবারও কিন্তু সংবাদ সম্মেলন করে বা বক্তব্য দিয়ে দেশের ভেতর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইবেন। আর এসব কাজে ভারত সরকারও সবসময় তার পাশে থাকবে। কারণ শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে যেভাবে যা দিয়েছে, অন্য কোনো সরকার তা করতে রাজি হবে না বিধায় ভারত সবসময় শেখ হাসিনাকে মদদ জোগাবে। আর এ সত্যটি মেনে নিয়েই ভবিষ্যতে আমাদের দেশ পরিচালনা করতে হবে।

ছাত্ররা যদি একটি নতুন দল করতে চান, তাহলে সে কাজটিও তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করে নির্বাচনের মাধ্যমে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন করে পূর্ণাঙ্গ একটি মন্ত্রিসভার মাধ্যমে দেশটি পরিচালিত হোক। আমার মনে হয়, ছাত্রদের নতুন দলেরও ক্ষমতায় থাকা উচিত এবং এক্ষেত্রে দেশের মানুষও তাদের বিমুখ করবেন বলে মনে হয় না; অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তাদের নতুন দলও ভালো করবে বলে আমার ধারণা।

কারণ দেশের মানুষের বুকের ওপর থেকে স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর সরিয়ে ফেলতে ছাত্র-জনতার অবদান দেশের মানুষ ভুলে যাবেন, এমনটি নয়। তবে নতুন দল গঠন করে তা গুছিয়ে নিতে সময়ের প্রয়োজন এবং সেই কারণে নির্বাচন যতটা পেছানো যায়, সেই দর্শনে পথ চললে বিলম্বিত সময়ে অশুভ শক্তি যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না, তারও কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সে কারণেই অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভার দক্ষ ও শক্তিশালী একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : বীর মুক্তিযোদ্ধা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম