তুরস্কের কৌশলী পদক্ষেপ

ড. সিনেম চেঙ্গিজ
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারার সাম্প্রতিক আঙ্কারা সফরের সময় খবর প্রকাশিত হয়েছিল, তুরস্ক ও সিরিয়া একটি যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে বিবেচনা করছে, যার মধ্যে সিরিয়ার মধ্য অঞ্চলে তুর্কি বিমানঘাঁটি স্থাপন এবং সিরিয়ার নতুন সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে তুর্কি কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সামরিক ঘাঁটি নিয়ে চুক্তি সম্পর্কে কিছু বলার মতো সময় এখনো হয়নি। একই সময়ে তারা সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে তুরস্কের সহযোগিতার খবর অস্বীকারও করেননি।
এই প্রথমবারের মতো দামেস্কের সঙ্গে আঙ্কারার একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিষয় প্রকাশ্যে এলো। বহু বছর ধরে তুরস্ক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে সরকারবিরোধী এবং অন্যান্য উপাদানের বিরুদ্ধে লড়াইরত সিরিয়ান বাহিনীকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে। সিরিয়ার নতুন সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর এক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি হিসাবেই বিবেচিত হবে। গত বছর তুরস্ক এবং তার অন্য এক প্রতিবেশী ইরাকের মধ্যে অনুরূপ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
গত বছরের এপ্রিলে আঙ্কারা ও বাগদাদ সামরিক প্রশিক্ষণসহ বিস্তৃত ও ব্যাপক পরিসরে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছিলেন, এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সাধারণ হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংলাপ বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তায় অবদান রাখা। এ চুক্তি ছিল ইরাকের সঙ্গে বহু বছর ধরে চলা উত্তেজনার পর তুরস্কের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি সাফল্য।
এ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে, কারণ ইরাকের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে পিকেকে’র কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে, যে সংগঠনকে তুরস্কও সন্ত্রাসী হিসাবে ঘোষণা করেছে। আল-শারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার সরকার পিকেকে ও ওয়াইপিজিকে সিরিয়া থেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে দেবে না। পিকেকে এবং এর শাখাগুলো ইরাক ও সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিতর্কের বিষয় ছিল। অভ্যন্তরীণ ও দ্বিপাক্ষিক উভয় কারণেই এ বিষয়টি ব্যতিক্রমীভাবে সহযোগিতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অতীতে উত্তর ইরাকে পিকেকে’র বিরুদ্ধে তুর্কি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের ফলে তুরস্ক-ইরাক সম্পর্ক গুরুতরভাবে সংকটাপন্ন হয়েছিল। ইরাকের বাশিকা ক্যাম্পের কাছাকাছি তুর্কি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল এর একটি প্রধান কারণ। তবে নতুন চুক্তির ফলে বাশিকায় একটি যৌথ প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা কেন্দ্র স্থাপিত হবে, যার দায়িত্ব ইরাকি সশস্ত্র বাহিনীর ওপর থাকবে। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, আঙ্কারা প্রধানত পিকেকে এবং এর শাখাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত সন্ত্রাসবাদের উদ্বেগের কারণে সিরিয়া ও ইরাকের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সুরক্ষিত করার দিকে মনোনিবেশ করছে। এটি তুরস্কের জন্য স্বস্তির বিষয়, যা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অবসানের আশা জাগায়।
তুরস্ক তার প্রতিবেশীদের পরিবর্তন করতে পারবে না, কিন্তু তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আঙ্কারার প্রথম সখ্য ছিল বাস্তব রাজনীতির প্রয়োজন দ্বারা চালিত (তুর্কি সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ)। এর একটি উদাহরণ হলো, সাদাবাদ চুক্তি (প্রতিরক্ষা চুক্তি), যা ১৯৩৭ সালে তুরস্ক, ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করার প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলোর একটি ছিল, যা এদেশগুলোর অস্থির সময়ে সহযোগিতার ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার কারণে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবুও এ চুক্তি আঞ্চলিক কূটনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল, বিশেষত তুরস্ক এবং এর প্রতিবেশীদের জন্য।
ইরাকের সঙ্গে তুরস্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল, যার নাম বাগদাদ চুক্তি; এটি ১৯৫৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ১৯৫৮ সালে ইরাকের প্রত্যাহারের পর এ চুক্তির নাম পরিবর্তন করা হয়-এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ এবং এর সদর দপ্তর আঙ্কারায় স্থানান্তরিত হয়। তবে এ মৈত্রীরূপও ধীরে ধীরে ভেঙে যায়। এসব উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট হয় হুমকি মোকাবিলায় কীভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক চুক্তি প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলো প্রায়ই অর্থনৈতিক সহায়তার পথকে আরও বিস্তৃত করে, কারণ এ ধরনের চুক্তির আওতায় থাকা দেশগুলো সাধারণত সম্পদ ভাগাভাগির উদ্যোগগুলোকে সমৃদ্ধ করতে চায়। উল্লেখ্য, তুরস্ক, ইরাক ও সিরিয়া আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা ভাগাভাগি করে, যা তাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ইরাকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তি তুরস্কের সঙ্গে বহু বিলিয়ন ডলারের কৌশলগত পানি চুক্তির পথ প্রশস্ত করেছিল। সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের একটি অনুরূপ চুক্তি সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলবে, যা পানিকে বিরোধের বিষয় থেকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করবে।
যেহেতু তুরস্ক, ইরাক ও সিরিয়া ভিন্ন মাত্রায় নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করছে; সেহেতু কৌশলগত স্বার্থে এ তিন দেশের পরস্পরের সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় সংযুক্ত থাকা উচিত। নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি বা একই ধরনের অন্য চুক্তির আওতায় এ তিন দেশ পরস্পরের সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগির মাধ্যমে এ অঞ্চলে আরও সমন্বিত ও স্থিতিশীল নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করতে পারে। এসব প্রক্রিয়া এ তিন দেশের উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : মোহাম্মদ কবীর আহমদ
ড. সিনেম চেঙ্গিজ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক