Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

একুশের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে

Icon

ওয়াকিল আহমদ

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একুশের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে দেশের কতিপয় তরুণ আত্মাহুতি দেয়। তারা মাতৃভাষা বাংলাকে নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্দোলন করছিল। মাতৃভাষা দেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে গণ্য হলে জাতির জনজীবনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিল। এ জন্য অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার জন্য তারা প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি যখন একাকার হয়ে যায়, তখন তা অসীম শক্তি ধারণ করে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় জীবনে ক্রমান্বয়ে একটি বিমূর্ত চেতনায় পরিণত হয়। আগুনের উত্তাপ ও আলোকশিখা যেমন উৎসভূমিতে কেন্দ্রীভূত থাকে না, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা তেমনি কাল ও উৎসভূমিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। জাতির জীবনে ও মননে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়ে তা ক্রমশ শক্তিশালী ও বেগবান রূপ ধারণ করেছে। তার বড় প্রমাণ, ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ-সংগঠন ইউনেস্কো কর্তৃক অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে স্বীকতি প্রদান। এটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি বড় গৌরব, একটি মহৎ অর্জন।

অমর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাপ্তি দ্বিবিধ-আত্মিক ও বস্তুগত। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে সমগ্র জাতি মর্মলোকে এক ধরনের টান অনুভব করে, নানা কাজের মধ্যে যার প্রতিফলন ঘটে। বিশেষ করে, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারসহ সারা দেশের শহিদ মিনারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান, বাংলা একাডেমিকেন্দ্রিক মাসব্যাপী অনুষ্ঠান ও বইমেলা, বইমেলা উপলক্ষ্যে শত শত বই রচনা, মুদ্রণ ও প্রকাশ, হাজার হাজার দর্শকের আগমন ও বই কেনা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এ টানের তথা একুশের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এ টান আসে ভেতর থেকে, কাউকে বলে দিতে হয় না। আমি একে একুশের আত্মিক প্রাপ্তি মনে করি।

বিশ্ববাসী অমর একুশকে এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে পালন করে। আমরা ‘জাতীয় শোক দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উভয় রূপে পালন করি। বিশ্ববাসীর কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কালক্রমে বেড়েই চলেছে। সিয়েরা লিওনের মতো দেশ বাংলা ভাষাকে সরকারি দ্বিতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করেছে। একেও আমি অমর একুশের আত্মিক প্রাপ্তি বলে মনে করি।

সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস আন্দোলন অমর একুশের চেতনার অপর আত্মিক প্রাপ্তি। প্রতিবাদী চেতনায় ও স্বাধিকার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার মানুষ একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রক্ত ঝরেছে অনেক; ‘এক সাগর রক্তে’র বিনিময়ে স্বাধীনতা নামের লাল গোলাপটি অর্জিত হয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে এ এক মহৎ অর্জন। এ নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ মহত্তম ঘটনা।

অমর একুশের বস্তুগত প্রাপ্তি অনেক। প্রথমত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কথা বলতে হয়। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার শুধু ভাষা-শহিদদের উদ্দেশে নিবেদিত স্মৃতিফলক নয়, এর সঙ্গে সব শ্রেণির মানুষের আবেগ-অনুভূতি, বাদ-প্রতিবাদ, ক্ষোভ, সংগ্রাম জড়িয়ে পড়েছে। শহিদ মিনার যেমন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি বহির্বিশ্বেও বিস্তার লাভ করেছে। জাপানে নির্মিত শহিদ মিনার তার অন্যতম প্রমাণ।

কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতা এখন জাতির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষকে স্পর্শ করেছে। দিনের শুরুতে ‘প্রভাতফেরি’ ছিল সর্বজনীন, প্রথম থেকেই তা চালু ছিল। রাত বারটার পরপরই শহিদ মিনারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা, রাজনৈতিক দলের নেতা ইত্যাদি। পরে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে, শহিদ মিনারে জনতার ঢল নামে। এটা শুরু হয় স্বাধীনতা লাভের বেশ কয়েক বছর পর। অমর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে খালি পায়ে, ফুল হাতে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে প্রভাতফেরির রীতি-প্রথা আগের মতো অব্যাহত থাকে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের অনুসরণে প্রধান প্রধান শহর, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনারগুলোতে প্রভাতফেরির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয়। দ্বিতীয়ত বাংলা একাডেমির কথা আসে। ভাষা আন্দোলন ও অমর একুশের প্রেক্ষাপটেই ঢাকার বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষার উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ। গবেষণা-প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাংলা একাডেমি বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ ও সেমিনারাদির অনুষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতার পর অমর একুশে উদযাপন উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী বইমেলার আয়োজন যুক্ত হয়ে এর কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। ১ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলার উদ্বোধন করে একে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছেন। এখন বইমেলা উপলক্ষ্যে প্রতি বছর বাংলা ভাষায় রচিত সহস্রাধিক নতুন বই প্রকাশিত হয়। শত-সহস্র পাঠক-দর্শক মেলায় ভিড় করেন এবং পছন্দের বই সংগ্রহ করেন। বেচা-কেনার অঙ্ক কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরূপ বইমেলার আয়োজন বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে হয়তো একদিন দেশের প্রধান শহরগুলোতেও বিস্তার লাভ করবে। শহিদ মিনারের প্রভাতফেরিতে এবং বাংলা একাডেমির বইমেলায় সব সম্প্রদায়ের সব বয়সের সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। অমর একুশে জাতিকে সম্পূর্ণ সেক্যুলার হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধানের কথা বলতে হয়। স্বাধীন দেশের সংবিধান রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়, হাজার বছরের ইতিহাসে যার কোনো নজির নেই। জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা হয় এবং তা কার্যবিবরণী হিসাবে নথিভুক্ত হয়।

চতুর্থত, জাতিসংঘের সাধারণ বার্ষিক সভায় সরকারপ্রধান কর্তৃক বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান। এটা সম্ভব হয়েছে একটি জাতির মাতৃভাষা একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা বলে।

মহান একুশের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতির একটি প্রত্যাশা ছিল-জনজীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়-এ ক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষার মাধ্যমে পাঠদান বহাল থাকলেও মাতৃভাষার পক্ষে অবস্থার গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাঠ্যপুস্তক, পরিভাষা ইত্যাদির অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ইংরেজির স্থলে বাংলা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। আবার বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রবাহের যুগে ইংরেজি ভাষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বলেও অনেকে ইংরেজির পক্ষে রায় দেন। সরকারি অফিস-আদালতে একই যুক্তি দেখিয়ে বাংলার প্রচলন স্থবির হয়ে পড়েছে। আইনের যুক্তিযুক্ততা বাংলা ভাষায় যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায় না-এই অজুহাত।

বিগত আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত গাড়ির নম্বর, দোকানপাটের নাম-ঠিকানা বাংলা ভাষায় লেখা হতো। আজ ইংরেজি নাম ও ভাষা সর্বত্রই চোখে পড়ে। দোলাচল হৃদয়বৃত্তি (half hearted) নিয়ে কাজ করলে ফল যা হয়, এ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও ইংরেজির পেছনে ছুটছে মানুষ। শহরগুলো কিন্ডার গার্টেনে ছেয়ে গেছে। ইংরেজি জানলে বিদেশে পাড়ি দেওয়া সুবিধা হয়। ভাষা জানলে বিদেশে যাওয়া যায় সত্য, কিন্তু জ্ঞান না থাকলে কোনো কাজে সাফল্য লাভ করা যায় না-এটাও সত্য। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভে প্রকৃত জ্ঞান জন্মে, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়-এ কথা ধ্রুবলোকের মতো সত্য। আমাদের বৈষয়িক বুদ্ধি আমাদের নৈতিক বুদ্ধিকে গ্রাস করে ফেলেছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা না বাংলা, না ইংরেজি কোনো ভাষাতেই দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারছি না।

বাংলা ভাষাকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আজ থেকে একশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনিই প্রথম মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছি। একশ বছরের ব্যবধানে বাংলা ভাষার যেরূপ উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল, সেরূপটি হয়নি। কেবল একুশের চেতনা ও আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে মেতে থাকলে চলবে না, জাতির প্রত্যাশাকে সফল করে তুলতে হলে এবং আমরা যা পেয়েছি, তার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হলে আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। ইংরেজি ভাষা বর্জন করার কথা আমরা বলি না; অমর একুশে আমাদের এরূপ শিক্ষা দেয়নি। অমর একুশে অর্জন করতে শেখায়, বর্জন করতে নয়। সব দেশের সব ভাষার প্রতি ভালোবাসা আর নিজের ভাষায় শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন-এটাই একুশের শিক্ষা। আমরা সব স্তরের কাজকর্ম করার জন্য নিজের ভাষা শিখব, আর বিশ্বকে জানার জন্য ও জ্ঞানলাভের জন্য অন্য ভাষাও শিখব। বিশ্বে অন্য অনেক কিছুর মতো যেভাবে ভাষার আধিপত্যবাদ চলছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দুর্বল ভাষাগুলো লোপ পেয়ে যেতে পারে। আসুন, আমরা ভাষার রাজ্যে আধিপত্যবাদ রোধ করি এবং সব ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলি। আমরা আগেই বলেছি, বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গেছে, আমরা পিছিয়ে আছি।

এখন আমাদের এগোতে হবে।

অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ : সাবেক উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সভাপতি, বাংলা একাডেমি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম