ভাষা আন্দোলনে সেনাবাহিনীর অবদান

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের সেনাবাহিনী প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রাখে। সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠালগ্নেও এর জ্বলন্ত একটি ঘটনা বা উদাহরণ তারা সৃষ্টি করেন। আমরা ভাষা আন্দোলনে তমুদ্দুন মজলিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবদান সম্পর্কে অবহিত। পরিতাপের বিষয়, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের ত্যাগের ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আর সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা দিবসে সংঘটিত হয়েছিল। জেনে অনেকেই অবাক হবেন, এ রেজিমেন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্পষ্টভাষী, তেজস্বী, নির্ভীক ও দুঃসাহসী কর্মকর্তা মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি ও মেজর এমআই হোসেন সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে গণ্য করতে থাকে। তাদের যুক্তি ছিল, বাংলা ভাষার ওপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্য হিন্দু লেখকদের ব্যাপক আধিপত্য বিধায় এদেশের বাঙালি মুসলমানরা হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এক সময়ে পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্যতার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। কেননা, পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব ছিল খুবই শক্তিশালী; যা সম্ভব হয়েছিল বাংলা ভাষায় তাদের আধিপত্যের কারণে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাথামোটা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী মাতৃভাষা, প্রাণের বাংলা ভাষাকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তা প্রকাশ ও পরিষ্কার হয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন ইস্টার্ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের (পরবর্তীকালে ফিল্ড মার্শাল ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট) একটি উক্তি বা নির্দেশের মাধ্যমে, যা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীতে। এটি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা : পরিতাপের বিষয় ছিল, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নামে নিজস্ব বাহিনী থাকলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিদের জন্য কোনো সেনাবাহিনীর রেজিমেন্ট ছিল না বা করা হয়নি। ফলে বাঙালি জনগোষ্ঠী অবহেলিতই থেকে যায়। এ থেকে উত্তরণের জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক কয়েকজন বাঙালি মুসলমান সেনা কর্মকর্তা বাঙালি রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর অতি অল্প সময়েই বাংলার বাঙালি মুসলমানদের বহুল প্রতীক্ষিত প্রাণের আকুতি, জেনারেল ওসমানী, জেনারেল ইশফাকুল মজিদ, মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি, মেজর এমআই হোসেন প্রমুখের আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপলাভ করতে শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এসব বাঙালি মুসলমান কর্মকর্তা ও আরও অনেকের ইচ্ছানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুসংহত ও রক্ষা করার অভিপ্রায়ে বাঙালি মুসলমানদের জন্য একটি রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; যার নামকরণ করা হয় ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। উল্লেখ্য, সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের নাম ছিল ‘ইস্ট বেঙ্গল’। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এ রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ম ইস্ট বেঙ্গল গঠন করার জন্য পত্র জারি করা হয়। ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুল গণি ও ক্যাপ্টেন এসইউ খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে এ ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করার। মেজর এ ডব্লিউ চৌধুরী ও মেজর সাজাউয়াল খানকে এ ইউনিটের দুটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন গণি ও অন্যান্য কর্মকর্তার আপ্রাণ চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গঠনের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল ভি. জে. ই. প্যাটারসনকে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় বাঙালি মুসলমানদের বহু প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। এ ঐতিহাসিক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ম ইস্ট বেঙ্গল, যা ‘সিনিয়র টাইগার’ নামে পরিচিত। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, মন্ত্রী নবাব হাবিবউল্যাহ, মন্ত্রী নূরুল আমীন, মন্ত্রী আফজাল খান, মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার, মন্ত্রী আবদুল হামিদ খান, সামরিক বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইয়ুব খান, উচ্চপদস্থ সব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা।
পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলন করেন গভর্নর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন। শুরু হয় বাঙালিদের গৌরবময় ইতিহাসের শুভযাত্রা এবং মার্শাল রেস (যোদ্ধা জাতি) হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। অবমোচন হয় দুশ’ বছরের গ্লানি ও অবমূল্যায়নের। এর মাধ্যমে বীজ বপন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শুরুতেই আত্মপ্রকাশ করে একটি উজ্জ্বল সূর্যের মতো। এ যেন আমাদের জাতীয় পতাকারই রক্তিম লাল সূর্যের প্রতিচ্ছবি। ‘সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা’র মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার দীপ্ত আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গ শার্দুল’ বাহিনী। তখন কে জানত এই রেজিমেন্টই একদিন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করবে!
ভাষা আন্দোলনের সূচনা : এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের চা চক্রে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান সবার উদ্দেশে বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে বলেন, ‘From now on-words Bengali Soldiers will speak in Urdu, not in Bengali.’ সঙ্গে সঙ্গেই এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে সেখানে উপস্থিত মেজর এমআই হোসেন বলে ওঠেন, ‘Excuse me Sir, in West Pakistan Pathan soldiers have allowed to speak in Pestoo and Urdu. Similarly our Bengali soldiers should be allowed to speak in Bengali and Urdu.’ ক্ষুব্ধ আইয়ুব খান বলেন, ‘Nonsense, absurd sit down.’ ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানকে লক্ষ করে সবার সামনে আবেগতাড়িত হয়ে বলে উঠলেন, ‘Excuse me Sir, whatever Major M. I. Hossain has said is not correct. We Bengali soldiers will never speak in Urdu, but in our mother tongue Bengali.’ এর জবাবে আইয়ুব খান ‘Shut up. Sit down.’ বলে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) গণিকে থামিয়ে দেন। এ দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্য এ সময় থেকেই তাকে যেমন ‘টাইগার গণি’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়; তেমনি স্বাভাবিকভাবেই আবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মেজর এমআই হোসেন ও ক্যাপ্টেন গণির এ দুঃসাহসিকতাকে চরম অসদাচরণ মনে করে তাদের বিরুদ্ধে লেগে পড়ে। ফলে, তাদের পদোন্নতি স্থগিত হয়ে যায় এবং নানাভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। দেশ, জাতি ও মাতৃভাষার সম্মান, মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এরকম দুঃসাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার উদাহরণ একেবারেই বিরল এবং ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় তা অকল্পনীয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র ছয় মাস পর এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার অনেক আগেই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালেই প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাবাহিনীর মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি ও মেজর এমআই হোসেন হলেন মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী। তাই বলতে দ্বিধা নেই, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মহান ভাষা আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। অথচ সেনাবাহিনীর এ অতি গুরুত্বপূর্ণ বীরত্বগাথার ইতিহাস অনেকে জানে না এবং সেনাবাহিনীকে খাটো করার মানসিকতা পোষণ করে।
আজ এ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি এবং এটাই বাস্তব সত্য যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেসব মহান ত্যাগী ব্যক্তির বীরত্ব, সাহসিকতা ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা পেয়েছি একটি পতাকা ও একটি দেশ এবং কথা বলতে পারছি প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষায়। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তাদের রুহের মাগফিরাত ও জান্নাতে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করছি।
স্বাধীনতার পর শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও তার শাসনামলে বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করার পদক্ষেপ নেন। সেনাবাহিনীর কমান্ডগুলো আগে ইংরেজিতে দেওয়া হতো। জিয়াউর রহমান সেগুলো বাংলায় প্রচলন করেন। এটিও সেনাবাহিনীর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com