Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশপ্রেমের চশমা

ভালোবাসার শক্তির ইতিবাচক ব্যবহার

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভালোবাসার শক্তির ইতিবাচক ব্যবহার

ভালোবাসা সহজাত পবিত্র মানবীয় গুণ। ধর্ম, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষই ভালোবাসার গুণে গুণান্বিত। লেখাপড়া বা খেলাধুলা শিখতে হয়। চর্চা করতে হয়। ভালোবাসা শেখার জন্য তেমন কোনো কসরতের প্রয়োজন হয় না। লেখাপড়ায় ভালো না করতে পারলে অনেকে কোচিং করেন।

গান শিখতে ওস্তাদের শরণাপন্ন হন। ভালো খেলোয়াড় হতে হলেও অব্যাহতভাবে চর্চা করতে হয়। কিন্তু একজন প্রেমিক হতে এসব কিছুই করা লাগে না। ভালোবাসতে টাকা লাগে না। বিদ্যা অর্জন করতে হলে লেখাপড়া করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া লাগে। ভালোবাসতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার দরকার হয় না।

ভালোবাসার বিশ্বখ্যাত আইকন লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রজকিনী-চন্ডিদাস বা ইউসুফ-জুলেখাকে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভালোবাসা শিখতে হয়নি। ভালোবাসা এমন এক পবিত্র শক্তি, যা পৃথিবীকে প্রাণময় করে রেখেছে। ভালোবাসা না থাকলে পৃথিবী হতো শুকনো কাঠের মতো। মানুষ হতো রোবটের মতো। ভালোবাসার অদৃশ্য সুমিষ্ট বন্ধনে পরিবার টিকে থাকে। সমাজ টিকে থাকে। টিকে থাকে সভ্যতা ও মানবতা।

আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে এ দিবস পালনের রীতি বাংলাদেশে সংক্রামিত হয় ১৯৯০-এর দশকে। ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’ আখ্যায়িত করে ওই সময় ভারতে এ দিবস পালনের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। বাংলাদেশেও অনেকে এ দিবস পালনের বিরোধিতা করেন। বলা হয়, যখন এদেশে ভালোবাসা দিবস পালন করা হতো না, তখন কি আমাদের মধ্যে ভালোবাসার কমতি ছিল? এখন এ বিরোধিতা নেই।

তবে ক্রমান্বয়ে ভালোবাসা দিবস পালনের বিরোধিতা কমে এলেও সারা দেশের মানুষের মধ্যে এ দিবস উদ্যাপিত হতে দেখা যায় না। শহরের শিক্ষিত সমাজে এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ দিবস পালনের প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তারা এ দিবসে নিজের ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। উপহার বিনিময় করছেন। ফুল দেওয়া-নেওয়া করছেন। এ কারণে এ দিবসকে ঘিরে ফুলের দোকানে বিক্রি বেড়ে যায়।

দুঃখের বিষয়, ভালোবাসা দিবস উদযাপনকারীরা এ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার বহুধাবিস্তৃত পরিধিকে সীমায়িত গণ্ডির মধ্যে এনে অপরাধ করছেন। বিষয়টি খুলে বলা প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্কই ভালোবাসার ওপর টিকে আছে। পিতার সঙ্গে মাতার সম্পর্ক যেমন ভালোবাসার সম্পর্ক; তেমনি মাতার সঙ্গে পুত্রের সম্পর্কও ভালোবাসার সম্পর্ক।

একইভাবে ভাইয়ের সঙ্গে বোনের, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের, শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর, শিল্পীর সঙ্গে শিল্পকর্মের, ফুলবাগানের সঙ্গে মালির সম্পর্কও ভালোবাসার সম্পর্ক। মায়ের সঙ্গে পুত্রের ভালোবাসার সম্পর্কের কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে খরস্রোতা নদী সাঁতরে মাকে দেখতে গিয়েছিলেন। মাকে ভালোবাসেন বলেই একজন সম্মানিত রিকশাচালক ঈদের আগে কঠোর পরিশ্রম করে টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি কিনে গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করতে যান।

মায়ের হাতে শাড়ি তুলে দেওয়ার সময় এ শ্রমিকের চোখেমুখে আনন্দের আলো ঝলমল করে। এ আলোর নামই ভালোবাসা। অথচ, ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠান উদযাপনকালে এর নানাবিধ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত না করে কেবলমাত্র তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের প্রেম বিষয়ে অধিক আলোকপাত করা হয়। এ দিবসকেন্দ্রিক আলোচনা সভায় বয়স্করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের যৌবনকালের প্রেম-ভালোবাসার গল্প বলে ভালোবাসার বহুধাবিস্তৃত পরিধিকে যুবক-যুবতীদের প্রেমে কুক্ষিগত করে এক রকম অপরাধ করেন।

এ অন্যায় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি পথ আছে। সে পথ হলো ভালোবাসার সঞ্জীবনী শক্তিকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়া। যুবক-যুবতীর ভালোবাসার পাশাপাশি শ্রমিকের প্রতি মালিকের, মুরিদের প্রতি পিরের, শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের, মায়ের সঙ্গে পুত্রের, ভাইয়ের সঙ্গে বোনের এবং এমন আরও অনেক অনেক ক্ষেত্রের ভালোবাসার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করা। বিশেষ করে রাজনীতিসহ যেসব ক্ষেত্রে ভালোবাসার তীব্র খরা লক্ষিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা সৃষ্টিতে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া। আমি এখানে এমন একটি স্বল্প উদ্ঘাটিত ভালোবাসার সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করব।

আমি অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০তম উপাচার্য। সে অর্থে আমি প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রশাসনিক ও একাডেমিক অভিভাবক। শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। সে ভালোবাসা অব্যক্ত হলেও শক্তিমান। এমন ভালোবাসা কিন্তু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আলোচনায় ঠাঁই পায় না। সে আলোচনায় স্থান করে নেয় তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের কুসুম কুসুম উষ্ণ ভালোবাসা।

উপাচার্য হওয়ার আগে আমি চার দশক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলাম। তখন শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে মিলিত হতে পারেন। তাকে কাছে পান। অফিসকক্ষে গিয়ে তার সঙ্গে সহজে তার সংস্পর্শে আসতে পারেন। কিন্তু উপাচার্য মহোদয়কে তারা সহজে কাছে পান না। তার সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। তার অফিসকক্ষে যাওয়াও সবসময় সহজ হয় না। আমি উপাচার্য হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যের এ সম্পর্কের দূরত্ব ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তাদের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক যতটা বজায় রাখা যায়, তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তবে প্রশাসনিক কাজের চাপে শিক্ষার্থীদের বেশি সময় দিতে পারছি না। সে জন্য আমার মনোকষ্ট রয়েছে।

পূজার বন্ধে আমি খুলনায় থাকাকালীন খালেদা জিয়া হলের এক শিক্ষার্থী আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ লিখে তার অসুস্থতার কথা জানান। আরও অবগত করেন, তিনি ডাক্তারি চেকআপের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে মেডিকেলে অ্যাম্বুলেন্স থাকা সত্ত্বেও তাকে হয়রানি করা হয়। পরে তিনি বাধ্য হয়ে হেঁটে মেডিকেলে গিয়ে সেবা নেন। পরে ডাক্তার তাকে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হলে পৌঁছে দেন। মেয়েটি সন্তানসম্ভবা। আমি বিষয়টি বিশেষভাবে মনে রাখি। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে প্রথমে এ বিষয়ে খোঁজ নেই। মেয়েটির সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পারি, পরদিন তার পরীক্ষা আছে। আমি তার রুম নম্বর জেনে নিয়ে তাকে অ্যাম্বুলেন্স না ডেকে রুমে থাকতে অনুরোধ করি।

নিজে অফিসে যাওয়ার পথে হলে গিয়ে হল কর্মচারীদের তাকে যত্নের সঙ্গে আমার গাড়িতে তুলে দিতে বলি। পরে তাকে পরীক্ষাস্থলে নামিয়ে অফিসে চলে যাই। এর পরের পরীক্ষাগুলোর সময় কর্মব্যস্ততার কারণে আমি আর নিজে যেতে পারিনি। তবে প্রতি পরীক্ষার দিন আমার ড্রাইভারকে তাকে পরীক্ষাস্থলে পৌঁছে দেওয়ার এবং পরীক্ষা শেষে হলে নামিয়ে দেওয়ার সেবা দিতে থাকি। এতে আমার সামান্যতম অসুবিধা হয়নি।

কারণ, আমি অফিসে যাওয়ার পর আমার ড্রাইভার মিজান প্রায় একরকম বসেই থাকেন। কাজেই অসুস্থ শিক্ষার্থীকে এটুকু সেবাদানের আনন্দ থেকে আমি বঞ্চিত হব কেন? তবে শেষ পরীক্ষা হওয়ার পর বাড়ি চলে যাওয়ার সময় এ শিক্ষার্থীকে গাড়ি দিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কাজের ব্যস্ততায় একেবারেই তা ভুলে যাই। শিক্ষার্থীও হয়তো সংকোচে আমাকে ফোন করেননি। ওই সেবাটি না দিতে পারার মনোকষ্ট আমাকে পীড়া দেয়। দোয়া করি সন্তানসম্ভবা এ মেয়েটিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন তার রহমতের চাদরের নিচে স্থান দেন।

আর্থিকভাবে অসচ্ছল আরেক শিক্ষার্থী টিউশনি না পেয়ে ক্যাম্পাসে পিঠা বিক্রি করেন। বিষয়টি জেনে আমি কষ্ট পেলেও কৌতূহলী হই। এক প্রিয়ভাজন ছাত্রের কাছ থেকে বিষয়টির সত্যতা জানি। বলি, তুমি তাকে আমার সঙ্গে সম্ভব হলে দেখা করতে বলবে। এর চার-পাঁচ দিন পর এই সাহসী তরুণ শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা আমার সঙ্গে অফিসকক্ষে এসে দেখা করেন। আমি তার সঙ্গে কথা বলে কিছুটা আবেগাপ্লুত হই। মনে হয় আমি যেন আমার প্রবাসী ছোট মেয়ের সঙ্গে কথা বলছি। জানতে পারি কিছুদিন আগে তার চুলা জ্বালানোর কাঠ চুরির কথা।

আমি এ ব্যাপারে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করি। তারা মেয়েটির কর্মস্থলে অধিকতর আলোর ব্যবস্থা করে দেন। তার কর্মপ্রচেষ্টাকে মসৃণ করার জন্য গ্যাসের চুলা ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেই। এরপর প্রটকল না মেনে ক্যাম্পাসে নৈশ টহল প্রদানকালে প্রায়ই তাকে কর্মব্যস্ত দেখলে আমি তার দোকানে দাঁড়াই। অবশ্যই পিঠা খাওয়ার জন্য নয়। তাকে সহায়তা করার জন্য। কারণ, আমি আমাকে দাঁড়াতে দেখলে অনেক শিক্ষার্থী আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেন। এতে তার বিক্রি বাড়ে। এ ছাড়া একটি বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগাযোগ করিয়ে দিলে সে দিনব্যাপী সেখানে ব্যবসা করতে পারে। কীভাবে তার ক্ষুদ্র ব্যবসাকে অধিকতর গতিশীল করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা করি।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্প করাকালীন অনেকে বলেন, তারা উপাচার্যের বাংলোতে কখনো যাননি। আমি অনেক সময় তাদেরকে নিয়ে আসি। তারা পাহাড়ের উপরে উঠে বিভিন্ন ফুল দেখেন। সামান্য চা-বিস্কুট খাওয়াই। এতে তারা খুব খুশি হন। আমিও আনন্দ পাই। ভালোবাসা পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়। আমি যেমন শিক্ষার্থীদের দেখে খুশি হই, শিক্ষার্থীরাও আমাকে দেখে খুশি হন। আমার সংস্পর্শে আসতে চান।

আমি ক্যাম্পাসে একা গাড়ি নিয়ে ঘুরি। কর্মব্যস্ততা না থাকলে কোনো শিক্ষার্থীকে একা হাঁটতে দেখলে মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করি, তুমি কোথায় যাবে? দূরবর্তী গন্তব্যের কথা বললে বলি, আমি তো ওদিকেই যাব, এসো আমার গাড়িতে ওঠো। তোমাকে নামিয়ে দেব। জুমার নামাজে যাওয়ার সময় টুপি মাথায় কাউকে দেখে বুঝি তিনিও হয়তো মসজিদে যাবেন। আমি তাদেরকে গাড়িতে তুলে নেই। এতে তারা খুশি হন। আমি তাদের সমস্যার কথা শুনি। বিভাগের অবস্থা জানতে চাই। ক্লাস পরীক্ষার কথা জানতে চাই। অনেকে বলেন, স্যার আমি জীবনে প্রথমবারের মতো একজন উপাচার্যের গাড়িতে উঠলাম।

ভালোবাসা দিবসে কেবল যুবক-যুবতীদের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া যথার্থ নয়। এ নিবন্ধে উল্লেখিত ভালোবাসার বিভিন্ন রকম সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা উচিত। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন বিশৃঙ্খল। এ বিশৃঙ্খলা দূর করতে ভালোবাসার সঞ্জীবনী শক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যে নিহিত পবিত্র ভালোবাসার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্যাম্পাসকে অধিকতর উপভোগ্য ও মধুময় করা সম্ভব।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম