আয়নাঘর : রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নির্মম স্মারক

একেএম রেজাউল করিম
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘আয়নাঘর’ একটি নাম, একটি প্রতীক, একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। এটি শুধু একটি বন্দিশালা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক নির্মম স্মারক, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বছরের পর বছর। আজ যখন এটি জনসাধারণের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে, তখন শিউরে ওঠার মতো বাস্তবতা সামনে আসছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ‘গুম’ শব্দটি আজ সাধারণ হয়ে উঠেছে। নাগরিকরা নিখোঁজ হয়, আর ফিরে এলেও তারা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করে। কারণ, এ নিখোঁজ হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের মনোজগতে যে ক্ষত তৈরি করে, তা আমরণ বয়ে বেড়াতে হয়। যারা কখনো ফিরে আসেননি, তারা কোথায়? কীভাবে তাদের দিন কাটত? কী নিপীড়ন তারা সহ্য করেছেন? ‘আয়নাঘর’ সে প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।
গোপন বন্দিশালার ভয়াবহতা
সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ‘আয়নাঘর’ নামক নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দিদের ওপর চালানো হয়েছে অমানবিক অত্যাচার। রিভলভিং চেয়ারে হাত-পা-মাথা বেঁধে ঘোরানো হতো, যা স্পষ্টতই নিপীড়নের একটি কৌশল। বন্দিদের মাছের কাঁটা বা ধারালো কণা দিয়ে দেওয়ালে লেখার সুযোগ পেতে হতো, যাতে অন্তত নিজের অস্তিত্বের কিছু চিহ্ন রেখে যাওয়া যায়। সারভাইভারদের ভাষ্যমতে, এত ছোট ও বদ্ধপরিবেশে রাখা হতো, অনেকের মনে হতো, যেন কফিনে আটকে আছেন।
তদন্তকারীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, কারাগারের টয়লেটগুলোর দরজায় ফুটো রাখা হতো, যাতে বন্দিদের ওপর নজরদারি চালানো যায়। এমনকি কোথাও কোথাও ওয়াশরুমেও ক্যামেরা ছিল। এটি শুধু নির্যাতন নয়, এটি একজন বন্দির মানবিক মর্যাদার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি।
গুমের সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় নীরবতা
কেন এতদিন ‘আয়নাঘর’ নিয়ে তদন্ত হয়নি? কেন একে জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করতে এত দীর্ঘ সময় লেগেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার এক গভীর সংকটকে সামনে নিয়ে আসে। ডিজিএফআই এবং অন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো বরাবরই নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। মিডিয়ার চাপে ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার এখন এ নির্যাতনকেন্দ্র দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে যারা এসব অপরাধ সংঘটিত করেছে, তারা কি আদৌ বিচারের মুখোমুখি হবে?
আমরা দেখেছি, কীভাবে নির্যাতনের প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। দেওয়াল রং করা হয়েছে, নতুন ওয়াল বানানো হয়েছে, এমনকি নির্যাতনের রুমগুলোর কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ বন্দিদের হাতে লেখা নম্বর, কাকুতি-মিনতির চিহ্ন এখনো দেওয়ালে রয়ে গেছে, নীরব সাক্ষী হয়ে।
মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন
‘আয়নাঘর’ শুধু একটি বন্দিশালা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় জুলুমের এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানবাধিকারের নামে জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা বলে, কিন্তু এতদিন তারা কী করেছে? শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় শেষ করেছে।
বিচারের দাবি
এখন সময় এসেছে, প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার। ডিজিএফআই, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি সত্যিই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের উচিত এ বন্দিশালার দায় স্বীকার করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা। রাষ্ট্র যদি নিজেই অন্যায়ের রক্ষক হয়, তাহলে জনগণ ন্যায়বিচারের আশা কোথায় করবে?
‘আয়নাঘরে’র মতো আরও কত গোপন বন্দিশালা দেশে ছড়িয়ে আছে, তা আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি, কোনো অন্যায় চিরস্থায়ী হয় না। সময়ের কাছে, ইতিহাসের কাছে, একদিন না একদিন সবাইকে জবাবদিহি করতে হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
ইঞ্জিনিয়ার একে এম রেজাউল করিম : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণাকেন্দ্র